চাকরির তদবিরে বিব্রত পিএসসি, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন

0
194
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)

চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তবে চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। বর্তমানে চাকরিপ্রার্থীদের কাছে ভরসাস্থল পিএসসি। বিসিএসসহ বিভিন্ন নবম ও দশম গ্রেডের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে থাকে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু বর্তমানে উচ্চপর্যায়ের কিছু ব্যক্তির তদবিরের কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিব্রত। এসবের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় প্রার্থীকে চাকরির পরীক্ষায় টেকানো বা ভাইভায় নম্বর দেওয়ার মতো তদবিরে বিব্রত পিএসসি। এখন এটি বন্ধে বিশেষ কৌশল নিতে চায় সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি। পিএসসির বিভিন্ন সূত্র প্রথম আলোকে বিষয়টি জানিয়েছে।

জানতে চাইলে পিএসসি সূত্র বলেন, সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী পর্যায় এমনকি বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সচিব, উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে চাকরিতে টেকানো বা ভাইভায় বেশি নম্বর দেওয়ার তদবির পায় পিএসসি। এতে বিব্রত হওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি। কেননা পিএসসি এমনভাবে পরীক্ষা নেয়, তাতে কোনো পরীক্ষার্থীর খাতা কোনোটি তা পরীক্ষকেরাও বলতে পারেন না। কেননা খাতা দেখতে দেওয়ার সময় খাতার ওপরে পরীক্ষার্থীর কোনো তথ্য রাখা হয় না। একইভাবে ভাইভা বোর্ড তৈরি করার সময় এমনভাবে রোল সাজানো হয়, তাতে কোনো পরীক্ষার্থী কোনো পরীক্ষকের অধীনে থাকা বোর্ডে পড়েছেন তা নির্ণয় করা যায় না। এমনকি পিএসসি চেয়ারম্যানও তা জানেন না বা বলতে পারেন না।

চাকরিপ্রার্থী মো. রজব আলী বলেন, ‘পিএসসির নিয়োগে দুর্নীতি হয় না। তাই শুধু বিসিএস টার্গেট করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি। দুটি ভাইভা দিয়ে চাকরি না পেয়েও আফসোস নেই। হয়তো প্রস্তুতি কম ছিল তাই পাইনি। আমার মতো অন্য চাকরিপ্রার্থীরাও মনে করেন সঠিক প্রস্তুতি থাকলে মেধাবীরাই পিএসসির চাকরির নিয়োগে নির্বাচিত হয়। আশা করব, পিএসসি যেন সব সময় বেকারদের ভরসাস্থল হয়ে থাকে।’

পিএসসির উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তদবির এমন পর্যায় থেকে আসে, তাতে আমাদের বিব্রত হতে হয়। একদিন এমন একজন সম্মানিত ব্যক্তি তদবির করলেন। তিনি একজনের রোল নম্বর দিয়ে বললেন আমার আত্মীয়। তাকে দেখবেন। তখন পিএসসির কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে পাস করেছেন। এ সময় তদবিরকারী প্রার্থীর তেমন কোনো তথ্য বলতে পারলেন না। বললেন, জানাচ্ছি। পিএসসির ওই কর্মকর্তা বলেন, দেখেন, তদবির করছেন আত্মীয়র বিষয়ে। আমি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম তদবিরের ধরনটা কী। তিনি কি আসলেই তাঁর আত্মীয় কি না। অথচ প্রার্থীর বিষয়ে কিছুই বলতে পারলেন না তদবিরকারী। পরে তথ্যগুলো জানাবেন বলে ফোন রেখে দিয়েছিলেন। পরে যখন আবার ফোন করেন, তখন তাঁকে জানানো হয় তদবিরের সুযোগ নেই বা এতে কাজ হবে না। বরং তদবির করলে অযোগ্যতা হবে। আমরা প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে দিতে পারি। এ কথা শোনার পর তদবিরকারী মন খারাপ করে ফোন রেখে দেন।

এই প্রতিবেদক, বিভিন্ন সময় পিএসসির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার কাছে গিয়ে অনেক মন্ত্রী–সংসদ সদস্যের ডিও লেটার দেখতে পান। যাতে বিভিন্ন প্রার্থীকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। এটা তো গেল লিখিত নথি। এসব ডিও লেটার পাঠানোর পাশাপাশি ফোন দিয়েও তদবির করা হয়। উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের ফোন পেয়ে না ধরা শিষ্টাচারবহির্ভূত মনে করে ওই ফোনগুলো ধরতে হয় কর্মকর্তাদের। তাঁরা যখন কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময়ের পর তদবির করেন, তখন বিব্রত হন পিএসসির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। তদবিরে পিএসসি কর্মকর্তারা বিরোধিতা করে মুখের ওপরে কিছু বলতে পারেন না ঠিকই কিস্তু এটি আমাদের সার্বিক কাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা এমন অনৈতিকতার চর্চায় বিব্রত তো হই–ই কোনো কোনো সময় হতাশও হই। এটি কতটুকু নৈতিক, সেটির প্রশ্নও থাকছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা চাকরিপ্রার্থী মো. রজব আলী দুটি বিসিএসের ভাইভা দিয়েছেন। আরও একটি ভাইভার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পিএসসির নিয়োগে দুর্নীতি হয় না। তাই আমি শুধু বিসিএস টার্গেট করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি। দুটি ভাইভা দিয়ে চাকরি না পেয়েও আমার আফসোস নেই। হয়তো প্রস্তুতি কম ছিল তাই পাইনি। আমার মতো অন্য চাকরিপ্রার্থীরাও মনে করেন, সঠিক প্রস্তুতি থাকলে মেধাবীরাই পিএসসির চাকরির নিয়োগে নির্বাচিত হন। আশা করব, পিএসসি যেন সব সময় বেকারদের ভরসাস্থল হয়ে থাকে।’

এ ব্যাপারে পিএসসির পরীক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর বলেন, বিসিএস পরীক্ষায় অনিয়ম না ঢোকার কারণে এটি বর্তমানে তরুণদের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন মহল থেকে তদবির আগেও ছিল, কিন্তু বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছ। তারিক মনজুর মন্তব্য করেন, যদি উচ্চপর্যায় থেকে পুনঃপুন তদবির আসতে থাকে এবং কোনো কারণে এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম ঢুকে যায়, তবে চাকরিপ্রত্যাশীদের শেষ ভরসার জায়গাটি নষ্ট হয়ে যাবে। এমনকি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও দুর্বল হয়ে পড়বে যোগ্য প্রার্থীর অভাবে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পিএসসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেকে তদবির করে মনে করেন কাজ হবে। আসলে আমাদের সেটি শোনা ছাড়া আর কোনো কিছুই করার থাকে না। পরীক্ষার্থীদের খাতা কোনটি বা ভাইভায় কোনো বোর্ডে পড়েছেন, তা খাম খোলার আগে আমিও বলতে পারিনি। আমরা সব সময় তদবিরকে নিরুৎসাহিত করি। এ জন্য আমরা পিএসসির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সে বিষয়ে লিখে থাকি যে তদবির করা যাবে না। এটি হলে প্রার্থিতাও বাতিল হতে পারে। তদবির আসলে আমরা বিব্রত হই।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.