চিকিৎসক-নার্স দেখলেই কাঁদছে আক্রান্ত শিশু

0
122

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের চতুর্থ তলায় ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ফটকের কাছাকাছি যেতেই শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল ১১ মাস বয়সী মানহা কান্না করছে। শারীরিক দুর্বলতার পাশাপাশি ব্যথায় কাতরাচ্ছিল সে। তার দুই খালা নানাভাবে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। এ সময় মানহার মা সানজিদা বলেন, ‘শরীরে আর সুঁই ফোটানোর জায়গা নেই। তাই আজ মাথা থেকে রক্ত নিয়ে গেলেন নার্স। ব্যথার পাশাপাশি এখন মা-খালা বাদ দিয়ে যাকেই দেখছে, ভয়ে কাঁদছে মানহা।’

গতকাল শনিবার এসব কথা বলেন পুরান ঢাকার নারিন্দার বাসিন্দা সানজিদা। তিনি জানান, গত ৩০ জুন রাতে মানহার জ্বর আসে। সঙ্গে বমি হচ্ছিল। পরদিন চিকিৎসকের কাছে গেলে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে বলেন। পরীক্ষায় মানহার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সানজিদা বলেন, ‘আমাদের এলাকা অনেকটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তার পরও কেন যে মেয়েটার ডেঙ্গু হলো।’

চতুর্থ তলার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে দেখা যায়, মানহার মতো ৯ মাস বয়সী শিশু ইব্রাহিমও ব্যথায় কাঁদছে। ক্যানুলায় এক হাত ফুলে গেছে। সে কারণে ক্যানুলা দিতে হয়েছে আরেক হাতে। মা আকলিমা খাতুন স্যালাইনের ব্যাগ এক হাতে ধরে অন্য কোলে তাকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন।

তিনি জানান, রায়েরবাজারে টিনশেডের বাসায় স্বামী-সন্তানসহ থাকেন আকলিমা। কয়েকদিন আগে বৃষ্টিতে ঘরে হাঁটুপানি ওঠে। এর পরই জ্বর আসে ইব্রাহিমের। এখন সে ব্যথায় কাঁদছে। কোনোভাবেই কান্না থামানো যাচ্ছে না। আকলিমা বলেন, ‘চার দিন হাসপাতালে আছি। ছেলেটা ডাক্তার-নার্স দেখলেই ভয় পায়, কান্না করে।’

হাসপাতালের নিচ তলায় ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কথা হয় ৬ বছর বয়সী নাফিয়ার চাচা আইনাল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘৬ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি নাফিয়া। তার শরীরের অবস্থা ভালো না। জ্বর সেরেছে। তবে শরীর অনেক দুর্বল। কিছু খেতে পারছে না। বমি করছে।’

একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ১০ বছর বয়সী সাজিম। সে যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসায় আবাসিকে থেকে পড়াশোনা করে। ঈদের ছুটিতে টাঙ্গাইলে গ্রামে বাড়িতে যায়। ফেরার পর তার জ্বর আসে। জ্বর না সারায় তাকে কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় সেখান থেকে শিশু হাসপাতালে স্থানান্তর করেন চিকিৎসকরা। সাজিমের মা বলেন, ‘ওর বাবা সৌদি আরবে থাকেন। আমি একলা ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’

মাগুরা থেকে ডেঙ্গু নিয়ে এই হাসপাতালে ৯ দিন ধরে চিকিৎসাধীন রিয়াজ। ক্যানুলায় তার এক হাত ফুলে গেছে। তার সঙ্গে থাকা নানি বলেন, ‘জ্বর ছিল, আগে বুঝতে পারিনি। এলাকার ডাক্তার দেখে বললেন, অবস্থা ভালো না, ঢাকায় নিয়ে যান। এখানে এসে ডেঙ্গু ধরা পড়ে।’

চতুর্থ তলার ডেঙ্গু ওয়ার্ডের নার্স নীলিমা জানান, এই ওয়ার্ডে বর্তমানে ১২ শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। বেশিরভাগ আক্রান্ত শিশুরই জ্বরের পাশাপাশি বমি হয়। এই ওয়ার্ডের কোনো শয্যা ফাঁকা থাকে না। বিকেলে কাউকে ছাড়পত্র দিলে পরই আবার নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এই হাসপাতালের দুটি ওয়ার্ডে মানহা ও ইব্রাহিমের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রায় ৪০ শিশু ভর্তি রয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকেও আসছে রোগী। ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক নিশাত জাহান বলেন, প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু হাসপাতালে আসছে। এক শিশু এসেছে শক সিনড্রোম নিয়ে। জ্বর সেরে যাওয়ার তিন দিন পর তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন স্বজনরা। এবার জ্বর ছাড়াও পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা, বমি নিয়ে হাসপাতালে আসছে শিশুরা। এর পর ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর শুরুতে জ্বর আসে, মাথাব্যথা হয়, শরীর, চোখ ও পেট ব্যথা করে। অনেকের বমি হয়। প্রায় চার দিন টানা জ্বর থাকার পর কমে যায়। তখন থেকে ডেঙ্গুর কমপ্লিকেশন যেমন প্লাজমা লিকেজ, পেটে-বুকে পানি জমা ও রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। হেমোরেজিক বা দাঁত, নাক, ফুসফুস ও পায়খানার সঙ্গে রক্তক্ষরণ হয়। অনেক শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এভাবে নানা উপসর্গ নিয়ে শক সিনড্রোম দেখা দেয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.