ছয় বছর আগে ঢাকার ধানমন্ডিতে তিন কোটি টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট কেনেন মজিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। তখন তিনি নিজের পরিচয় দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। এই পরিচয়ে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও হন তিনি। কিছুদিন পর মজিবুর জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তিনি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অথরাইজড অফিসার হিসেবে বদলি হয়েছেন। তখন মজিবুরের কাছে একটি প্লট কেনার বিষয়ে সহায়তা চান মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক প্রতিবেশী।
একপর্যায়ে প্লট বিক্রির নাম করে মোস্তাফিজুরের কাছ থেকে তিন কোটি সাত লাখ টাকা নেন মজিবুর। কিন্তু সেই প্লট নিবন্ধন করে দেননি। বিষয়টি নিয়ে চাপ দেওয়ায় উল্টো মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা করেন তিনি।
নিজেকে উপসচিব ও রাজউকের কর্মকর্তা পরিচয় দিলেও মজিবুর রহমানের প্রকৃত পরিচয় তিনি খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (চেইনম্যান)। এই পদে থেকেই একসময় চাকরিচ্যুত হন। তিনি কখনো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। এসব পরিচয়ে প্রতারণা করে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
ঢাকার ধানমন্ডি থানার একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ওই মামলায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর মজিবুরের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পিবিআই। প্রতারণার অভিযোগে গত বছর ৩ মার্চ মজিবুরের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় মামলাটি করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে, ১৯৯৮ সালে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেইনম্যান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন মজিবুর রহমান। সেখানে তিনি ১০ বছর কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালে তাঁকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অফিস সহায়ক হিসেবে বদলি করা হয়। কিছুদিন পর সেখান থেকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে বদলি করা হয়। ২০১৯ সালে তাঁকে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে বদলি করা হয়। তবে সেখানে তিনি যোগদান না করে বদলির আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। পরে তাঁকে বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে বদলি করা হয়। সেখানে যোগদানের এক মাস পর থেকে তিনি কর্মস্থলে আর যাননি। পরে ২০২০ সালে কর্মস্থলে অনুপস্থিত, অসদাচরণ, অবহেলার কারণে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তখন তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়।
পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান বলেন, প্লট বিক্রির নাম করে অর্থ আত্মসাৎ করার যে অভিযোগ মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, সেটির সত্যতা পাওয়া গেছে। পাশাপাশি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তিনি প্রতারণা করছেন। এসব বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পরই তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
বিপুল সম্পদের মালিক
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালেও মজিবুর রহমান ঢাকার হাতিরপুলের পুকুরপাড়ের একটি ভবনের পাঁচতলার দুই কক্ষের ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন। অথচ এখন তিনি বসবাস করেন ধানমন্ডিতে তিন কোটি টাকার নিজের ফ্ল্যাটে। মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে তাঁর মালিকানাধীন ১২০০ বর্গফুটের আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তাঁর নিজের নামে দুটি বিলাসবহুল গাড়িও রয়েছে। খুলনার সোনাডাঙ্গায় অর্ধকোটি টাকা দামের একটি প্লট রয়েছে। ওই প্লটে তৈরি করা বাড়িতে তাঁর শাশুড়ি ও শ্যালিকা থাকেন। ওই বাড়িটি স্থানীয়ভাবে উপসচিবের বাড়ি হিসেবে চেনেন সবাই। এ ছাড়া খুলনার ময়ূরী আবাসিক প্রকল্পে তাঁর নিজের ৫ কাঠার একটি প্লট রয়েছে।
যাঁর টাকা আত্মসাৎ, তাঁর বিরুদ্ধেই মামলা
পিবিআইয়ের তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে ধানমন্ডির ১১/এ নম্বর সড়কের ৭৭ নম্বর প্লটে ৮ তলা ভবন নির্মাণ করে কনকর্ড গ্রুপ। ভবনের নামকরণ করা হয় কনকর্ড নুসরাত। সেখানে ২৩০০ বর্গফুটের ১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ওই ভবনের দোতলায় মজিবুর একটি ফ্ল্যাট কেনেন। আর ৬ তলার একটি ফ্ল্যাট কেনেন মোস্তাফিজুর রহমান। একই ভবনের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে তাঁদের পরিচয় হয়। তা ছাড়া ওই ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মজিবুর রহমান। ওই ভবনের সব বাসিন্দা জানতেন, মজিবুর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। পরে ২০২০ সালে মজিবুর সবাইকে রাজউকের অথরাইজড অফিসার হিসেবে বদলি হওয়ার কথা বলেন। তখন মোস্তাফিজুর রহমান পূর্বাচলে একটি প্লট কেনার আগ্রহ প্রকাশ করলে এ বিষয়ে সহায়তার কথা বলেন মজিবুর।
মোস্তাফিজুরকে একটি প্লটের সন্ধানও দেন মজিবুর। মোস্তাফিজুরকে তিনি জানান, তাঁর (মজিবুর) এক সহকর্মী পূর্বাচলে সাড়ে ৭ কাঠার একটি প্লট বিক্রি করে আমেরিকায় চলে যেতে চান। ওই প্লটের দাম তিন কোটি টাকা। প্লটের আমমোক্তারনামা নিয়ে রেখেছেন মজিবুর নিজে। প্লটটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে সেটি কেনার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন মোস্তাফিজুর। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে জমির দাম হিসেবে তিন কোটি এবং অন্যান্য খরচ হিসেবে সাড়ে সাত লাখ টাকা পরিশোধ করেন মোস্তাফিজুর।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, টাকা পরিশোধ করার পর প্লট নিবন্ধন করে দিচ্ছিলেন না মজিবুর রহমান। পরে বিষয়টি সন্দেহ হলে তাঁর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি একজন প্রতারক। পরে টাকা ফেরত চাইলে গড়িমসি শুরু করেন।
একপর্যায়ে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকেন তিনি। এমনকি অস্ত্রধারী কয়েকজন বাসায় এসে হুমকিও দেয়। রাস্তায় তাঁর ওপর হামলারও চেষ্টা করে মজিবুর। কয়েক দিন পর তিনি জানতে পারেন, তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন মজিবুর রহমান।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ধানমন্ডি থানায় মামলা হয় ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এই মামলা শুরুতে ধানমন্ডি থানা-পুলিশ তদন্ত করলেও পরে মামলার তদন্তভার পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। পিবিআই ২০২২ সালের মে মাসে ওই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পাশাপাশি বাদী মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এরপর মজিবুরের বিরুদ্ধে মোস্তাফিজুরের দায়ের করা মামলার তদন্ত করে পিবিআই।
তাদের তদন্তের বিষয়ে মজিবুর রহমান আজ রোববার বলেন, পিবিআই প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উল্লেখ করেছে, এগুলোর সবই মিথ্যা। তিনি কখনোই কোনো ধরনের প্রতারণা করেননি। মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে তিনি কোনো টাকা নেননি। মোস্তাফিজুরই তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তা ছাড়া তিনি কখনোই উপসচিব বা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দেননি বলেও দাবি করেন। তাঁর বিপুল সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
ভুক্তভোগীর পক্ষে নয়, প্রতারকের পক্ষে ছিল পুলিশ
পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে, ভুয়া অঙ্গীকারনামা তৈরি করে মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে মামলা করেন মজিবুর রহমান। অথচ ধানমন্ডি থানা-পুলিশ যাচাই-বাছাই ছাড়াই মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা নিয়েছে।
এ ঘটনায় শুরু থেকেই ধানমন্ডি থানা-পুলিশ মজিবুরের পক্ষে অবস্থান নেয় বলে অভিযোগ করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, যিনি প্রতারণা করলেন, তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে মামলাও নেওয়া হয়। কিন্তু ভুক্তভোগী হিসেবে তিনি (মোস্তাফিজুর) মামলা করতে গেলে থানা-পুলিশ ফিরিয়ে দেয়। ১০ দিন বিভিন্ন দপ্তরে ঘোরাঘুরির পর থানা-পুলিশ মামলা নেয়। মোস্তাফিজুরের অভিযোগ, ধানমন্ডি থানার ওসি (তৎকালীন) ইকরাম আলী মিয়া এবং পুলিশের ধানমন্ডি অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (তৎকালীন সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মাসুম) মজিবুরের পক্ষে কাজ করেন। তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করেন এই পুলিশ কর্মকর্তারা। মজিবুরের পক্ষে পুলিশের একজন ডিআইজিও (উপমহাপরিদর্শক) নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন বলে তিনি জানতে পারেন।
এ বিষয়ে পুলিশের ধানমন্ডি অঞ্চলের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (বর্তমানে গুলশান অঞ্চলে কর্মরত) আব্দুল্লাহ আল মাসুম বলেন, ওই ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানতেন। ওই সময় মজিবুর ও মোস্তাফিজ দুজন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিলেন। এ কারণে দুজনের মামলাই নেওয়া হয়। ঘটনার গভীরে যাওয়ার আগেই মামলা পিবিআইতে চলে যায়। এ কারণে তখন থানা-পুলিশ বিস্তারিত তদন্ত করেনি। আর মোম্তাফিজুর রহমান যেসব অভিযোগ করছেন, এগুলো সঠিক নয়। তাঁকে সহযোগিতা করা হয়েছে।
আর ধানমন্ডির তৎকালীন ওসি ইকরাম আলী বলেন, তিনি যা করেছেন আইন মেনেই করেছেন। দুই পক্ষের মামলাই নিয়েছেন।
তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তাহেরুল হক চৌহান বলেন, মজিবুর যে মামলাটি করেছিলেন সেটি থানা-পুলিশের রেকর্ড করা উচিত হয়নি। ওই মামলাটি থানা-পুলিশ কেন নিয়েছিল, সেটি জানার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসেননি।
এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানা-পুলিশ ভুক্তোভোগীর বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে যেটা করেছে, তাতে স্পষ্ট তারা প্রতারকের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে এমনটা করেছে বলে মনে করছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ উমর ফারুক। তিনি বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায় এবং প্রতারকেরা এ ধরনের অপরাধ করতে সাহস পায়। এ ধরনের ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।