
চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি ঘোষণার পর এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছে কমিটিতে থাকা ছাত্রনেতাদের একাংশ। নতুন ঘোষিত তিনটি কমিটি বাতিলের দাবিতে দিনভর সড়ক অবরোধ করেন পদত্যাগ করা নেতা ও তাঁদের সমর্থকেরা। তাঁদের অবরোধের মধ্যেই আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে গণপদযাত্রা করেছে কমিটিতে থাকা আরেক অংশ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগর এবং চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ জেলার কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সদস্যসচিব আরিফ সোহেলের সই করা ওই তিনটি কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয় আগামী ছয় মাসের জন্য। সংগঠনটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া ওই তিনটি কমিটিতে মোট ৭৫৪ জনের নাম রয়েছে।
কমিটি ঘোষণার পর আজ মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেয় কমিটিতে থাকা শিক্ষার্থীদের একাংশ। সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, তিন কমিটির অন্তত ৫০ থেকে ১০০ জন পদত্যাগ করেছেন। তবে সংবাদ সম্মেলনে তিন কমিটিতে থাকা ৩০ জনের মতো উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কমিটিতে সম্মুখযোদ্ধাদের সুযোগ দেওয়া হয়নি। যাঁদের বিরুদ্ধে নারী হেনস্তা ও কিশোর গ্যাংকে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের নিয়ে একপক্ষীয় কমিটি দেওয়া হয়েছে। সনাতন ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। নারী সহযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সেখানে বক্তব্য দেন নতুন কমিটিতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক পদে থাকা জোবায়রুল আলম, নগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে থাকা চৌধুরী সিয়াম ইলাহি ও সংগঠক আবু বাছির নাঈম।
নগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে থাকা চৌধুরী সিয়াম ইলাহি বলেন, ‘যদি কোনো কারণে এ কমিটি বাতিল না করে উল্টো তাঁদের সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে আমরা হাসনাত আবদুল্লাহকে বীর চট্টলায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করব।’ দক্ষিণ জেলার জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক পদে থাকা জোবায়রুল আলম বলেন, চট্টগ্রামের স্থানীয়, আহত, মূল আন্দোলনকারী এবং নারীদের কাউকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই।’
সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো মূল আন্দোলনকারীদের নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করতে হবে; আগামী তিন দিনের মধ্যে কমিটি গঠনের আগে অভিযুক্ত সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং ব্যক্তির পছন্দে গঠিত কমিটিসমূহ গঠনের সঙ্গে জড়িতদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সড়ক অবরোধ, পদত্যাগের হুঁশিয়ারি
সংবাদ সম্মেলনের পর কমিটি বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধের ডাক দেন উপস্থিত নেতা-কর্মীরা। আজ বেলা সোয়া একটার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জামালখান, আসকার দীঘির পাড় ও কাজীর দেউড়ি হয়ে টাইগারপাস মোড়ের দিকে যান শিক্ষার্থীরা। এরপর সিডিএ অ্যাভিনিউ সড়কের টাইগারপাসমুখী সড়কে বসে অবরোধ করেন তাঁরা।
বেলা দেড়টার দিকে লালখান বাজার এলাকায় সড়ক অবরোধ শুরু করেন কিছু শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নতুন তিন কমিটি থেকে পদত্যাগ করা প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন রয়েছেন। সড়কের এক পাশ অবরোধ করা হলেও অন্য পাশ দিয়ে যান চলাচল অব্যাহত রয়েছে। তবে এর প্রভাবে লালখান বাজারসহ আশপাশ এলাকাগুলোয় যানজট দেখা দিয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাঁরা লালখান বাজারে অবস্থান নিয়ে বসে ছিলেন।

এ কর্মসূচি চলাকালের নিজের ফেসবুক আইডিতে পদত্যাগের হুঁশিয়ারি দেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাসেল আহমেদ। সেখানে তিনি লেখেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামে উদ্ভূত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান আজ (মঙ্গলবার) সন্ধ্যার আগে করা না হলে আমি এবং সম্মুখসারিতে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সহযোদ্ধাসহ এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে যেতে বাধ্য হব।’ যদিও সন্ধ্যার পর এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিজাউর রহমানকে আহ্বায়ক ও সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী নিজাম উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ৩১৫ সদস্যের মহানগর কমিটি দেওয়া হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জোবাইর হোসেনকে আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে ৩২৭ সদস্যের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইয়াছির আরফিন চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মো. রইছ উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ১১২ সদস্যের চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটি দেওয়া হয়েছে।
তিন কমিটির গণপদযাত্রা
এদিকে তিন কমিটির একাংশ পদত্যাগের ঘোষণা করলেও কমিটিতে থাকা নেতা-কর্মীরা গণপদযাত্রা করেছেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিতে চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম উত্তরের ব্যানারের এই কর্মসূচি হয়। পদযাত্রায় বৈষম্যবিরোধী নেতা-কর্মীরা বলেন, আওয়ামী লীগের মতো দলের আর বাংলাদেশের রাজনীতি করার অধিকার নেই। তাঁরা অনতিবিলম্বে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চান।
আজ বিকেল সাড়ে চারটায় নগরের ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যান থেকে এই পদযাত্রা শুরু হয়। পরে এটি ২ নম্বর গেট, জিইসি মোড়, ওয়াসা হয়ে কাজীর দেউড়ি গিয়ে শেষ হয়। এরপর সেখানে নেতা-কর্মীরা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। সরেজমিনে দেখা যায় মিছিলে থাকা একটি অংশ ওয়াসা থেকে লালখান বাজার হয়ে কাজীর দেউড়ি এলাকায় যেতে এগিয়ে যায়। তবে লালখান এলাকায় আগে থেকেই নতুন কমিটির পদবঞ্চিত একাংশ অবরোধ করছিল। তাই পুলিশ সেদিকে যেতে বাধা দেয়। পুলিশের বাধায় নেতা-কর্মীরা আলমাস সিনেমা হলের সামনে দিয়ে কাজীর দেউড়ি যান।
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগর শাখার আহ্বায়ক রিজাউর রহমান বলেন, ‘আমাদের কমিটির যে পদ রয়েছে এটি শুধু পদ নয়। এটি একটি দায়িত্ব। এই দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করাই হবে আমাদের একান্ত কর্তব্য। এই কর্তব্য নিয়ে আমরা এসেছি ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও মুজিববাদী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে।’