প্রয়াত সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীর ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গানের সঙ্গে চট্টগ্রামের একটি ঘটনা যেন মিলে যাচ্ছে। এই গানের একপর্যায়ে বলতে শোনা যায়, ‘আরে মাটি খালো কিডা…’। তবে এ ক্ষেত্রে মাটি নয়, বালু ‘খাওয়া’ হয়েছে। জেলার সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. রুহুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের জব্দ করা ২৫ লাখ ঘনফুট বালু ‘হাওয়া’ করে দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনার জেরে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, রুহুল্লাহ চৌধুরীর জিম্মায় আদালতের জব্দ করা বালু ছিল। তবে পরে তাঁর কাছ থেকে কম পরিমাণ বালু পাওয়া যায়। এ কারণে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
২০ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব জেসমিন প্রধানের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে রুহুল্লাহ চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করায় তাঁর বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বালু উত্তোলনের অভিযোগ
রুহুল্লাহ চৌধুরী সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভীর শ্যালক ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সাবেক সদস্য মুমিনুল হকের ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে আগে থেকেই চরতি ইউনিয়নে অবৈধ বালু উত্তোলনের অভিযোগ ছিল। ২০২১ সালে চরতীতে বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়ায় গুলিতে ১৩ কৃষক আহত হন। ওই ঘটনায় রুহুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। গত বছর রুহুল্লাহ চৌধুরী ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
চলতি বছরের ১৪ মার্চ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্তের ভ্রাম্যমাণ আদালত চরতি ইউনিয়নে সাঙ্গু নদ থেকে বালু উত্তোলনরত অবস্থায় একটি এক্সকাভেটর সহ ৫০ লাখ ঘনফুট বালু জব্দ করেন। অভিযোগ রয়েছে, ওই বালুমহাল রুহুল্লাহ চৌধুরীর। ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত সেদিনই ৫০ লাখ ঘনফুট বালু ও একটি এক্সকাভেটর চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরীর জিম্মায় দেন।
তবে বালু চুরি হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন রুহুল্লাহ চৌধুরী। তিনি কাছে দাবি করেন, ‘আমি এখনো কাগজ হাতে পাইনি। তবে বালু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ৫০ লাখ ঘনফুট বলা হয়েছিল। অত বালু ছিল না। তারপরও আমি জিম্মানামায় সই করেছিলাম। এক্সকাভেটরটি কোথায় জানি না।’
‘দায় চেয়ারম্যানের ওপর বর্তায়’
বালু জব্দের পর ২ মে ইউএনও বরাবর নিলাম কমিটি একটি চিঠি দেয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের ৮ দিনের মাথায় ২২ মার্চ কমিটি প্রথম জব্দ করা বালু ও এক্সকাভেটর পরিদর্শনে ঘটনাস্থলে যায়। তখন সেখানে ৪০ লাখ ঘনফুট বালু পাওয়া যায়। বাকি ১০ লাখ ঘনফুট বালু ও এক্সকাভেটর পাওয়া যায়নি।
চিঠিতে বলা হয়, একই কমিটি ১৩ এপ্রিল আবার পরিদর্শনে গিয়ে ৩০ লাখ ঘনফুট বালু পায়। এর পাঁচ দিন পর ১৮ এপ্রিল পরিদর্শনে গিয়ে বালু পাওয়া যায় ২৫ লাখ ঘনফুট। প্রতি ঘনফুট বালু ১ টাকা করে ২৫ লাখ টাকা ও এক্সকাভেটরের দাম ১০ লাখ টাকা হিসেবে মোট ৩৫ লাখ টাকার সরকারি সম্পদ চুরি হয়েছে। জিম্মাদার বিষয়টি ভ্রাম্যমাণ আদালত বা নিলাম কমিটিকে যথাসময়ে অবহিত করেননি।
এরপর ইউএনও ফাতেমা তুজ জোহরা বালু ও এক্সকাভেটর চুরির বিষয়ে জেলা প্রশাসন বরাবর একটি প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনে চুরির জন্য জিম্মাদার হিসেবে রুহুল্লাহ চৌধুরীর দায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
নিয়মানুযায়ী উপজেলা বালু নিলাম কমিটির মাধ্যমে জব্দ করা বালু ও এক্সকাভেটর বিক্রির কথা। পাঁচ সদস্যের বালু নিলাম কমিটির আহ্বায়ক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী।
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রথম পরিদর্শনের পর যতবার গিয়েছি, ততবার বালুর পরিমাণ কমেছে। এলাকাবাসী বলেছেন, বালু চুরি হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা নাম বলতে চান না। এক্সকাভেটরটিও চুরি হয়। এসবের দায় চেয়ারম্যানের ওপর বর্তায়।’