চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে মারামারি-বিক্ষোভ, দিনভর স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ

0
16
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের হাতাহাতি, মারামারি ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। আজ বুধবার দুপুরে

রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের হাতাহাতি, মারামারি ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে যায়। আজ বুধবার সকাল ৯টা থেকে কয়েক ঘণ্টা ধরে এ ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, হাসপাতালে রোগীদের নিরাপত্তা নেই। এভাবে হাসপাতাল চালানো যায় না। তিনি সাত দিনের ছুটি নিয়েছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের কয়েকজন গত মঙ্গলবার হাসপাতালের পরিচালককে অবরুদ্ধ করে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানালে পরিচালক কক্ষ ছেড়ে চলে যান। এর জের ধরে আজ সকালে নিজেদের নিরাপত্তা দাবি করে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীরা কর্মবিরতিতে যান। ওই সময় প্রথমে হাসপাতালে আসা সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে এবং পরে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কর্মচারীদের হাতাহাতি হয়।

পরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) থেকেও জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা এসে যোগ দিলে মারামারি আরও বড় আকার ধারণ করে। দফায় দফায় বিকেল পর্যন্ত উত্তেজনা তৈরি হয়, বিক্ষোভ হয়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠিচার্জ করে।

আজ দুপুরে আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সামনে সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও পুলিশের সদস্যদের দেখা যায়। প্রধান ফটক তালাবদ্ধ ছিল। বাইরে থেকে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারছিলেন না। অনেক রোগী ও স্বজন আতঙ্কে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রধান ফটকের বাইরে অপেক্ষা করেন। অনেক রোগী ভর্তি হতে এসে ফেরত যান।

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের অভিযোগ, তাঁরা উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। নামমাত্র চিকিৎসা পান। তাঁদের চোখের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। তাঁদের খাবারের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। হাসপাতালের কর্মচারীরা তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

অপর দিকে হাসপাতালের কর্মীদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি থাকা আহত ব্যক্তিরা অল্পতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বিদেশে চিকিৎসার জন্য চাপ দেন, তাঁদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন। সবশেষ গত মঙ্গলবার হাসপাতালের পরিচালককে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এর প্রতিবাদে আজ তাঁরা কর্মবিরতি পালন করছিলেন।

রোববার থেকেই জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উন্নত চিকিৎসার দাবিতে ওই দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চারজন বিষপান করলে তাঁদের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের চতুর্থ তলায় আটটি পুরুষ ওয়ার্ডে ৫০ জনের বেশি জুলাই আহত ব্যক্তি চিকিৎসাধীন।

আজ বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে হাসপাতালে আসেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) কামাল আকবর। তিনি হাসপাতালে এসে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটের দিকে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকের পরিস্থিতি নিয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা বসব। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করব। আমরা দেখব, এই মারামারিতে তৃতীয় পক্ষের কোনো ইন্ধন ছিল কি না।’

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ভেতরে বিক্ষোভ চলার সময় বাইরের সড়ক অবরোধ করে নিটোরে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের একটি অংশ। এ সময় শ্যামলী থেকে আগারগাঁও সড়কের এক পাশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে কামাল আকবরের অনুরোধে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে অবরোধ তুলে নেন আন্দোলনকারীরা।

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জানে আলম বলেন, আজ পরিচালকের কক্ষে আহত ব্যক্তিরা প্রবেশ করে নিজেদের মধ্যে তর্কে জড়িয়ে পড়েন, একপর্যায়ে হাতাহাতি করেন। তাঁদের একজন পেট্রলজাতীয় দাহ্য পদার্থ নিয়ে আসেন। তাঁরা আত্মহত্যা করতে চাইছিলেন, নাকি হাসপাতাল জ্বালিয়ে দিতে চাইছিলেন, তা পরিষ্কার নয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করছিলেন। সে সময় সেবাপ্রার্থী ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

হাসপাতালের অস্ত্রোপচারকক্ষের সহযোগী মো. সবুজ বলেন, আজ হামলায় তাঁর মাথা ফেটে গেছে। আরও ৮-১০ জন কর্মচারী আহত হয়েছেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোহান মাহমুদ বলেন, সকাল থেকে সব ধরনের সেবা বন্ধ করে হাসপাতালের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করছিলেন। জরুরি সেবাও দিচ্ছিলেন না। এটা নিয়ে সেবাপ্রার্থীরা প্রতিবাদ জানালে তাঁদের ওপর হামলা করেন কর্মচারীরা। এ সময় তাঁরা নিচে নেমে এলে তাঁদের ওপরও হামলা করা হয়। এতে তাঁদের ১০-১৫ জন আহত হন।

বগুড়ায় ৪ আগস্ট পুলিশের ছররা গুলিতে ডান চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয় মো. নাহার হাসানের। পরিচালকের কক্ষে বাদানুবাদের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হাসান বলেন, চিকিৎসা না পেয়ে হতাশা থেকে আহত ব্যক্তিরা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেদিন পরিচালককে অবরুদ্ধ করা হয়নি, তিনি আমাদের কথা না শুনে পাশের কক্ষ দিয়ে বেরিয়ে চলে যান।’

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতি ও মারামারির পর এক পর্যায়ে হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা আজ বুধবার দুপুরে
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতি ও মারামারির পর এক পর্যায়ে হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা আজ বুধবার দুপুরে

রোগীদের দুর্ভোগ

মারামারি শুরু হলে রোগী ও স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়। কেউ কেউ রোগী নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যান। অনেক রোগী ও স্বজন মারামারির সময় ভেতরে আটকে ছিলেন। বেলা আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা ভেতরে থাকা রোগী ও স্বজনদের বের করে নিয়ে আসেন।

আল কারিম নামে এক শিশুর চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে গত মঙ্গলবার। আজ তাঁকে ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিয়ে ছাড়পত্র দেওয়ার কথা ছিল। শিশুটির মা নাজমা বলেন, সকাল নয়টার দিকে হাতাহাতি–মারামারি শুরু হলে তিনি ও তাঁর স্বামী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁরা সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। বেলা দুইটা পর্যন্ত তিনি হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন।

আহতদের দাবি

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা লিখিত দাবিতে বলেন, ‘আমরা যে আশা ও আত্মত্যাগ নিয়ে জুলাই গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম, তার আজও পূর্ণতা নেই। দেশের পরিবর্তনের স্বপ্ন, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র, নিরাপদ সমাজ—সবই আজ আমাদের চোখে একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে।’

তাঁদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের বিদেশে চিকিৎসা, দেশে যাঁদের চিকিৎসা হবে, তাঁদের ভালো হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে হতে হবে। পুনর্বাসনের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী আহত ব্যক্তিদের চাকরি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বীকৃতি ও মাসিক সহায়তা দিতে হবে। ভুয়া আহত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.