ঈদের দিন কাজ করেন কল সেন্টারের কর্মীরা, ফোন ধরে বলেন ‘ঈদ মোবারক’

0
135
ঈদের দিন কল সেন্টারে থাকে উৎসবমুখর আবহ। গত ঈদে ডিজিকন কার্যালয়ে কর্মীরা

ঢাকার মিরপুর ১২ নম্বরের একটি ভবন। লিফট থেকে ছয় তলায় নামতেই পাওয়া গেল ঈদুল ফিতরের আবহ। অফিসের ভেতরে ঢুকতেই রঙিন চকচকে ঝালর, ছাদ থেকে ঝোলানো চাঁদ, তারা। দেয়ালে লেখা ঈদ মোবারক। তবে ঈদ উপলক্ষে শুধু নয়, ঈদের দিনের জন্য সাজানো হয়েছে অফিসের অভ্যন্তর। এটি দেশের বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং খাতের সফল প্রতিষ্ঠান ডিজিকন টেকনোলজিসের কল সেন্টার।

কল সেন্টার মানেই তো ২৪/৭, ৩৬৫ দিন ধরে সচল-সজাগ সব সময়। বিদ্যুৎ, মোবাইল ব্যাংকিং, টেলিভিশন সংযোগ সেবা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সেবা তো ছুটির দিন বা ঈদের দিন বলে মানবে না। যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে জরুরি দরকার পড়তে পারে।

তাই কল সেন্টারের কর্মীদের কাজ করতে হয় ঈদের দিনও। ঈদের দিন কল সেন্টারের কর্মীদের অভিজ্ঞতা জানতেই গতকাল বৃহস্পতিবার যাই মিরপুরে ডিজিকনের কল সেন্টারে। ঈদের দিন কর্মীরা কাজ করবেন, তাই ঈদের উৎসবমুখর আবহ তৈরি হচ্ছে তিনটি তলাজুড়ে এই কল সেন্টারে।

ঈদের সাজে অফিসে
ঈদের সাজে অফিসে

সুরাইয়া ইসলাম এক বছরও হয়নি কাজ করছেন ডিজিকনে গ্রাহক সেবা প্রতিনিধি বা কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে। এটাই তাঁর প্রথম চাকরি। বললেন, ‘আমি খুবই এক্সাইটেড, ঈদের দিনে অফিস করব ভেবে। পরিবারের বাইরে বড় একটা সময় কাটবে তা ঠিক, তবে এক বেলা তো তাদের পাব। আর সহকর্মীদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেব।’

ডিজিকনের পরিচালন প্রধান সোহম ঘোষ জানান, এই কল সেন্টার থেকে দেশের গ্রাহকদেরই মূলত সেবা দেওয়া হয়। এখান থেকে সোনালী ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদ, আকাশ ডিটিএইচ, ডেসকো, মধুমতি ব্যাংক, ইলেকট্রনিকস পণ্য নির্মাতা ওয়ার্লপুল, হায়ার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের ফোনকলভিত্তিক গ্রাহক সেবা দেওয়া হয়। যেকোনো সময় গ্রাহকেরা যেকোনো সমস্যার সমাধানে বা তথ্য জানতে ফোন করতে পারেন। তাই ঈদের দিনও সেবা চালু রাখাটা জরুরি।

সিএসআর জিন্নাত আরা ইয়াসমীন এবার পঞ্চমবারের মতো ঈদের দিন অফিস করবেন। জিন্নাত আরা বলেন, ‘অফিসের ঈদ অন্য রকম। এখন তো ঈদের দিন ডিউটি থাকলেই খুশি হই। সিনিয়ররা আসেন, শুভেচ্ছা পাই। ঈদের দিন অফিস উৎসবমুখর থাকে।’

ঈদের আনন্দে
ঈদের আনন্দে

বাসায় তো অতিথিরা বেড়াতে আসেন, তাঁদের বা পরিবারের সদস্যদের অভাব বোধ করেন না? জিন্নাত আরার উত্তর, ‘আমাদের তো শিফট ধরে কাজ করতে হয়। শিফটের আগে–পরে অতিথিদের সঙ্গে দেখা হয়। গ্রাহক যখন ফোন করে বলেন, “আজকেও কাজ করছেন?” তখন খুবই ভালো লাগে। গ্রাহককে তাঁর প্রয়োজনে সেবা দিতে পারছি, এই আনন্দ ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় অনেকটাই।’

ঈদের দিন সকালের পালায় কাজ পড়লে বেশি খুশি হন কল সেন্টারের কর্মী মাহমুদ আল নাহিদ। কারণ, এ ক্ষেত্রে বিকেলটা পাওয়া যায় বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের জন্য। তিনি বলেন, ‘এখানে পরিবেশটা বেশ বন্ধুবৎসল। সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক। ফলে আমরা ঈদের দিন অফিসের কাজ উপভোগই করি।’

গ্রাহক সেবা প্রতিনিধি ফয়সাল আহমেদের কোনো আক্ষেপ নেই ঈদের ছুটি না পাওয়ায়। তিনি ডেসকোর গ্রাহক সেবা দেন। তিনি জানান, ঈদের দিন ৯৫ শতাংশ কলই গ্রাহকদের কাছ থেকে আসে। অনেক গ্রাহক ফোন করে ঈদ মোবারক বলেন। এটা শুনতে খুবই ভালো লাগে।

মাহবুব আলম বলেন, ‘ঈদের দিন সবাই একসঙ্গে থাকি, এটাই বড় কথা। পুরোপুরি আনন্দে কাটে দিনটি। কিছু গ্রাহক ফোন করে ঈদ মোবারক জানান। এটাও বেশ ভালো লাগে।’

কল সেন্টার থেকে আকাশ ডিটিএইচের গ্রাহক সেবা দেন সোনিয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘এমনিতে আমরা গ্রাহকের ফোন ধরে গুড মর্নিং, গুড ইভিনিং বলি, কিন্তু ঈদের দিন আমরা ঈদ মোবারক বলে কথা শুরু করি। একবার ঈদের দিন কক্সবাজার থেকে এক গ্রাহক ফোন করে জানালেন, আকাশ ডিটিএইচ সংযুক্ত করার পর তাঁর টিভিতে কিছু দেখা যাচ্ছে না।

গ্রাহকের ফোনকলে
গ্রাহকের ফোনকলে

প্রথম দিকে বেশ বিরক্তই ছিলেন। এরপর তাঁকে কারিগরি ধাপগুলো বুঝিয়ে বলে সেগুলো করতে বললাম। সেসব অনুসরণ করে তিনি জানালেন, টিভি দেখা যাচ্ছে। খুশিতে তিনি দাওয়াত দিলেন, তাঁর বাসায় সেমাই খেতে যেতে বললেন।’

‘তিনি আপনাকে কক্সবাজারে তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন?’ সোনিয়ার আক্তার বললেন, ‘হ্যাঁ। কারণ, তিনি তো জানেন না, আমি কোথা থেকে ফোন ধরেছি।’

কুমকুম আক্তার এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার ঈদের দিনটা কাটাবেন অফিস করে। তিনি ডেসকোর হয়ে গ্রাহক সেবা দেন। বললেন, বেশির ভাগ কল আসে প্রিপেইড মিটারে টাকা ভরার বিষয়ে। টোকেন নম্বর যখন ঠিক হয়ে যায়, তখন ভালো লাগে। অফিস করে একবেলা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারি। তাই ঈদের আনন্দে কোনো কমতি হয় না।’

কল সেন্টারে প্রায় এক যুগের মতো কাজের অভিজ্ঞতা ডিজিকনের সিনিয়র ম্যানেজার অপারেশনস নাহিদ হাসানের। তিনি বলেন, ‘আমরা কর্মীদের বিষয়টা বুঝি। ঈদের দিন পরিবার-পরিজন ছাড়া আট-নয় ঘণ্টা অফিসে কাটাতে হয়, তাই অফিসে একটা উৎসবের পরিবেশ রাখার চেষ্টা করি। আমাদের মানবসম্পদ বিভাগ থেকে কর্মীদের জন্য ছোট ছোট খেলার আয়োজন করে। অফিসটা সাজানো হয়। আমরাও থাকি সেদিন।’

ঈদের দিনে চলছে কল সেন্টার
ঈদের দিনে চলছে কল সেন্টার

ম্যানেজার অপারেশনস ইন্দ্রাণী দত্তগুপ্তা বলেন, ‘আমরা যেসব প্রতিষ্ঠানের হয়ে গ্রাহক সেবা দিই, সেগুলোর প্রতিনিধিরা আসেন ঈদের দিন, শুভেচ্ছা জানাতে। গত ঈদে নগদের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কেক নিয়ে গেলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, গ্রাহকেরা বেশি খুশি হন, ঈদের দিনও তাঁদের প্রয়োজনীয় সেবা পেয়ে।’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনটাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্কো) সভাপতি এবং ডিজিকন টেকনোলজিস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদ শরীফ জানান, প্রায় সব কল সেন্টারেই ঈদের দিন একটা উৎসবমুখর পরিবেশ রাখা হয়। যেসব কল সেন্টারে ফোনকলনির্ভর গ্রাহক সেবা দিতে হয়, সেগুলো তো ঈদসহ সব ছুটির দিনই ২৪ ঘণ্টা ধরে খোলা রাখতে হয়।

ওয়াহিদ বলেন, ‘অফিসে ঈদের বিশেষ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে আমরা যারা আছি, তারাও অন্তত একটা বেলা ঈদের দিন কর্মীদের সঙ্গে কাটাই।’

দেশে এখন বিপিও খাতে কর্মীসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এর বড় একটা অংশ কল সেন্টারে কাজ করেন। ঈদের দিন গ্রাহকের দরকারি প্রয়োজনে ফোনে সমাধান দিয়ে যান তাঁরা। ফোন ধরে হাসিমুখে বলেন ‘ঈদ মোবারক’।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.