সঞ্চালন ও বিতরণ পর্যায়ে যথাযথভাবে গ্যাস সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ না করায় ঢাকার একটি বড় অংশজুড়ে সোমবার রাতে অস্বাভাবিক গ্যাস লিকেজের ঘটনা বড় ধরনের সতর্ক সংকেত হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা আবারও টের পাওয়া গেল। তিতাসের ইমার্জেন্সি টিম দ্রুত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ না করলে গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণ হয়ে ভয়াবহ বিপদ হতে পারত।
সোমবার গ্যাসের প্রকট গন্ধে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে রাতেই তিতাস কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও ভয় কাটেনি ঢাকাবাসীর। গ্যাস লাইনে ছিদ্রের কারণে গত দুই বছরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে একাধিক বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে শতাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, পুরোনো, জীর্ণ এবং অসংখ্য ছিদ্র থাকার কারণে এমনিতেই তিতাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি (জিটিসিএল) এবং তিতাসের অপারেশন বিভাগের সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণে রাজধানীবাসী সোমবার রাতে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। তাদের মতে, সময়মতো গ্যাসের সরবরাহ না কমানোর কারণেই লাইনের চাপ বেড়ে যায়। এমন ঘটনার দায় পেট্রোবাংলাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এড়াতে পারে না। সোমবার রাতের ঘটনার পরও গ্যাস কোম্পানিগুলোর টনক খুব বেশি নড়েনি বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। কারণ, ঘটনার জন্য সরকার শুধু ঈদের ছুটিতে গ্যাসের চাহিদা কমে যাওয়াকে দায়ী করে দায় এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। বিতরণ লাইনের দুরবস্থা, পরিচালনায় ঘাটতির বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। এমনকি ঘটনার তদন্তে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি।
সোমবার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা, বাড্ডা, রামপুরা, মহাখালী, মগবাজার, দিলু রোড, ইস্কাটন, হাজারীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্ক দেখা দেয়। এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, ঈদের ছুটিতে গ্যাসের চাহিদা কম থাকায় সরবরাহ বেশি থাকায় পাইপলাইনে চাপ বেড়ে গেছে। অনেক স্থানে লাইনে লিকেজ থাকায় গন্ধ ছড়িয়েছে।
১৮ এপ্রিল ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগে দেশে গ্যাসের সরবরাহ ছিল দিনে ২৯১ কোটি ঘনফুট। তিতাসের আওতাধীন এলাকায় সরবরাহের পরিমাণ ছিল ১৭৬.২৫ কোটি ঘনফুট। ঈদের ছুটিতে কলকারখানা বন্ধ থাকায় এবং বাসাবাড়ি ও পরিবহনের চাহিদা কমায় পেট্রোবাংলা গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। ২৪ এপ্রিল পেট্রোবাংলা সরবরাহ করে ২১২ কোটি ঘনফুট। তিতাসের এলাকায় সরবরাহ করা হয় ১০০ কোটি ঘনফুট। সূত্র জানিয়েছে, সরবরাহ যে পরিমাণ কমানো হয়, চাহিদা তার চেয়েও কম ছিল। তাই জিটিসিএলের উচিত ছিল আরও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা। তারা তা করেনি। সূত্রমতে, তিতাসের অপারেশন বিভাগের পক্ষ থেকেও চাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব ছিল। তারা তা করেনি। ফলে লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে ৩০ পিএসআইয়ে (প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে চাপ) পৌঁছায়। যা সাধারণ সময়ে ৫-৭ পিএসআই থাকে। ফলে লাইনে থাকা ছিদ্র বা ত্রুটিপূর্ণ সংযোগগুলো দিয়ে একযোগে গ্যাস নিঃসরিত হতে থাকে। পরে চাপ কমিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গত সোমবার রাত ৯টায় তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ডেমরা এলাকার ডিআরএস (ডিস্ট্রিক রেগুলেটিং স্টেশন) বন্ধ করেন, যা আরও আগে করা উচিত ছিল। তাহলে এমন গ্যাস লিকেজের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। সূত্র জানায়, গত বছর ঈদের ছুটিতে নারায়ণগঞ্জ এলাকায়ও স্বল্প পরিসরে গ্যাস নিঃসরণের ঘটনা ঘটেছিল। তখনও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে চাপ কমানো হয়েছিল। এর পরও তিতাস কর্তৃপক্ষ সচেতন হয়নি।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) কামরুজ্জামান খান বলেন, লাইনের ত্রুটি চিহ্নিত করতে সরবরাহ করা গ্যাসে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। তাই গন্ধ বেশি পাওয়া গেছে। এতে ত্রুটি শনাক্ত করা এবং মেরামত করা সহজ হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, সাধারণত কম চাপে গ্যাস সরবরাহ করার কারণে তিতাসের বিতরণ লাইনের ত্রুটিগুলো তেমনভাবে চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে কিছু এলাকায় বড় ধরনের গ্যাস লিকেজের ঘটনা ধরা পড়ে। সোমবার রাতে চাপ বেড়ে যাওয়া ঢাকার একটা বড় এলাকা জুড়ে যেভাবে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে এতেই বোঝা যায় তিতাসের বিতরণ লাইন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, পাইপলাইন, লাইনের সংযোগ সবকিছুর চাপ সহ্য করার সর্বোচ্চ মাত্রা আছে। চাপ বেড়ে গেলে সংযোগ পয়েন্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পুরোনো লাইনে ছিদ্র হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। আগের ছিদ্র দিয়ে গ্যাসের নিঃসরণ বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে সোমবার রাতের ঘটনা একটি বড় সতর্ক সংকেত।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, পাইপলাইনের ত্রুটি চিহ্নিত করতে এবং গ্রাহককে সতর্ক করতে সম্প্রতি বিতরণ কোম্পানিগুলোকে গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাই গত রাতে সবাই গন্ধ পেয়ে সতর্ক হয়েছে। তিনি বলেন, তিতাসের ২৫ বছরের চেয়ে পুরোনো যেসব লাইন রয়েছে সেগুলো পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনেন্দ্র নাথ বলেন, ঈদের ছুটির কারণে চাহিদা কমায় সরবরাহ এক-তৃতীয়াংশ কমানো হয়েছে। এর পরও চাপ বেড়ে যাওয়ায় গ্যাসের নিঃসরণ বেশি হয়েছে। সরবরাহ আরও কম থাকলে এমনটি হতো না। এ ঘটনায় বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানির কারও কোনো অবহেলা রয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, দায়িত্বে থাকা সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, জিটিসিএলকে সরবরাহ কমাতে বললে তারা ৭০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ কমিয়ে দেয়। তিনি বলেন, চাইলেও গ্যাস সরবরাহ ইচ্ছে মতো কমানো যায় না। এতে অনেক কূপের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এলএনজি সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে। তিনি মনে করেন, সোমবার রাতে যা ঘটেছিল, আতঙ্ক ছড়িয়েছে এর চেয়ে বেশি। তিতাস দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
জ্বালানি বিভাগের ব্যাখ্যা
সোমবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাতাসে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনার মঙ্গলবার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সোমবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঢাকার রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী, বেইলি রোডসহ কয়েকটি এলাকায় গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক তিতাস গ্যাসের ১৪টি ইমার্জেন্সি টিম ওইসব এলাকা পরিদর্শন করে এবং জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়। একই সঙ্গে যেসব ডিআরএসের (ডিস্ট্রিক্ট রেগুলেটিং স্টেশন) মাধ্যমে ঢাকায় গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে, সেগুলো থেকে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দেওয়া হলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
তিতাসের জীর্ণ লাইন ও বিস্ফোরণ
রাজধানীতে তিতাসের গ্যাস লাইনের অধিকাংশই ২০ থেকে ৪০ বছরের পুরোনো। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এসব লাইন ঝুঁকিপূর্ণ। সরবরাহ লাইনে রয়েছে শত শত ছিদ্র। অবৈধ সংযোগের কারণেও লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। সম্প্রতি ঢাকার ১ হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইনের ওপর এক পরীক্ষায় ৯ হাজার ৯২৬ স্থানে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত করে তিতাস। যার মধ্যে ৪৫৯টি ছিদ্র ধরা পড়ে। পরে সেগুলো সংস্কার করা হয়। গ্যাসলাইনে ছিদ্রের কারণে গত দুই বছরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে একাধিক বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে মারা যান ৩৪ জন। মগবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণে মারা যায় সাতজন। বিচ্ছিন্ন করা পাইপলাইন সংযোগ থেকে গ্যাস জমে এই দুই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সম্প্রতি সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ও সিদ্দিকবাজারে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনাও গ্যাসের পরিত্যক্ত লাইনের লিকেজ থেকে হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে। এই দুই বিস্ফোরণে মারা গেছেন ৩২ জন।