বিশৃঙ্খলা, অবিচার ও ভয় সুদানের বেশিরভাগ অংশকে গ্রাস করেছে। দেশটির দুই জেনারেলের মধ্যে যুদ্ধ এক সপ্তাহের বেশি সময় হয়ে গেছে, যা সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যার দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। জমজমাট রাজধানী খার্তুম একটি ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে উদ্বাস্তুর স্রোত শুরু হয়েছে। অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিও (যার মধ্যে রয়েছে ঈদের ছুটির দিন) সংঘর্ষ থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। সুদানি সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো তথা হেমেদতি নামে পরিচিত প্রভাবশালী আধা সামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের প্রধানের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বই এ সংঘাতের প্রধান কারণ। তাঁদের সংঘর্ষের কারণে সুদান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ, পানিসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহের অভাবে অনেক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন পক্ষের সশস্ত্র গোষ্ঠী বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করেছে। বেসামরিক নাগরিক, যারা নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে পালাতে সাহস করেনি, তারা ঘরের মধ্যে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। খার্তুমভিত্তিক বিজ্ঞান শিক্ষক আমার সহকর্মীদের বলেছেন, আমরা খবরে যা শুনি, তা মিথ্যা। ‘আগুন আরও প্রজ্বলিত হচ্ছে। আমরা এভাবে থাকতে পারছি না। বোমায় না মরলেও ক্ষুধায় মরব। বাজারে খাওয়ার কিছু নেই।’
রাজধানীতে তীব্র যুদ্ধের ফলে বেসামরিক মানুষের বাড়িতে মর্টার হামলা হচ্ছে এবং স্থানীয় মিলিশিয়াদের আস্তানা বিভিন্ন শহর ও পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। কম করে হলেও দেশব্যাপী সাড়ে চারশ মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে হাজার হাজার। নিহতের মধ্যে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার স্থানীয় কর্মীও রয়েছে। বিদেশিরাও সেখানে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহে মার্কিন কূটনীতিক বহনকারী একটি কনভয় অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন নেতৃস্থানীয় মানবিক সহায়তা কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। অনেক দেশ সুদান থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোববার তার দূতাবাসের কর্মীদের এবং তাঁদের পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে।
দাতা সংস্থাগুলো এমনিতেই দেশে গভীরতর মানবিক সংকট বিষয়ে সতর্ক করেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই সেখানে ক্ষুধা তীব্র আকার ধারণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশ চাদে পৌঁছেছে। আগামী দিনগুলোতে প্রায় এক লাখ সুদানি শরণার্থীর জন্য জাতিসংঘের কর্মকর্তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত সপ্তাহের শেষে সুদানের জন্য জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয়কারী আবদু দিয়েং শান্তির আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন– ‘যেহেতু আমরা পবিত্র রমজান মাস শেষ করেছি এবং ঈদুল ফিতর উদযাপন করছি– এখন শান্তি ও মিলনের সময়। আমি সবাইকে আহ্বান জানাই, সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলো অবিলম্বে লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য কাজ করুক।’
শান্তি কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ২০২১ সালে জেনারেল বুরহান ও হেমেদতি একটি দুর্বল বেসামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটাতে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন– তাঁরা একটি গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করবেন, যা ২০১৯ সালে দীর্ঘ একনায়ক শাসক ওমর আল বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা না করে উভয়েই তাঁদের অবস্থান সুসংহত করেন; সুশীল সমাজ ও গণতন্ত্রপন্থি শিবিরের সঙ্গে কাজ করেন (এমনকি তাঁরা ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ বেসামরিক শাসন পুনরুদ্ধার করার অঙ্গীকার করেন) এবং নিজেদের ও তাঁদের মিত্রদের সমৃদ্ধ করেন। সুদানের নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে হেমেদতির আরএসএফকে কীভাবে একীভূত করা যায়, তা নিয়ে মতবিরোধের মধ্যে উত্তেজনায় সংঘর্ষ শুরু হয়।
এখন দুই নেতা একে অন্যকে পরাজিত করার অঙ্গীকার করেছেন। সে জন্যই খার্তুমে সহিংসতার অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। ‘যদিও সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত রাজধানীকে সুরক্ষিত করে এবং হেমেদতি দারফুরে ফিরে যান।’ বিদ্রোহে বিধ্বস্ত অঞ্চল, যেখানে হেমেদতি সরকারপন্থি মিলিশিয়া নেতা হিসেবে তাঁর খ্যাতি তৈরি করেছিলেন; ‘সুদান গৃহযুদ্ধে অস্থিতিশীল হলে প্রতিবেশী চাদ, মধ্য আফ্রিকান রিপাবলিক, লিবিয়া ও দক্ষিণ সুদানেও তার প্রভাব পড়তে পারে। যেগুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় সংঘাতের কারণে ক্ষতবিক্ষত।’ গত সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি পলিসি মেমোতে এটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ‘এ ছাড়া সুদান অগণিত সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সাম্প্রদায়িক মিলিশিয়াতে ভরপুর। এগুলোর মধ্যে যে কেউ বা সবাই বুরহান বা হেমেদতির পক্ষে চলে যেতে পারে। এতে একটি দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।’
হেমেদতি লিবিয়ার জেনারেল খলিফা হিফটারের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছেন বলে জানা গেছে। যার নিজস্ব প্রচারাভিযান দারফুরের সুদানি যোদ্ধাদের দ্বারা চাপা পড়ে ছিল এবং যিনি রাশিয়ান ভাড়াটে কোম্পানি ওয়াগনারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, সুদানেও যার কার্যক্রম রয়েছে। কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ওয়াগনার হেমেদতির আরএসএফকে ভারী অস্ত্র স্থানান্তর করার প্রস্তাব দিয়েছিল। রাশিয়ান কর্মকর্তারা সুদান বন্দরের দিকেও নজর রেখেছেন, যা ক্রেমলিনকে লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরে একটি বড় নৌ উপস্থিতি দিতে পারে।
সুদান নিজেই এক জটিল আঞ্চলিক দাবা খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যেখানে আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম দেশটিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য রাশিয়া তাকে জালের মধ্যে রেখেছে। মিসর হলো বুরহানের কট্টর মিত্র, যিনি মিসরের অভ্যুত্থানকারী স্বৈরশাসক আবদেল ফাতাহ এল-সিসির সতীর্থ হিসেবে একই সামরিক কলেজে পড়াশোনা করেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে নিরপেক্ষতার ভান করলেও ইয়েমেনে প্রচারণা চালানোর জন্য হেমেদতির আরএসএফকে তালিকাভুক্ত করেছে। দুবাইয়ে হেমেদতি সুদানি সোনার জন্য লাভজনক এম্পোরিয়াম গড়ে তুলেছেন। ‘সবাই সুদানের একটি অংশ চেয়েছিল,’ রিফট ভ্যালি ইনস্টিটিউটের সুদানি বিশ্লেষক ম্যাগদি এল-গিজুলি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘অনেক বেশি স্বার্থের প্রতিযোগিতা এবং অনেক পক্ষ, তারপর ভারসাম্য হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, যেমন আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন।’
যে কূটনীতিকরা সুদানের বিপর্যস্ত রাজনীতি দেখেছেন, তাঁরা এখন সেখানে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ দেখছেন। এটি তাঁদের কাছে অপরিচিত নয়। প্রতিবেশী দক্ষিণ সুদানের অভিজ্ঞতাও জ্বলজ্বলে। যেটি কয়েক দশকের সংঘাতের পর খার্তুম থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল শুধু দুই যুদ্ধবাজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে। ‘অতীতে এমন পরিস্থিতি ছিল না। এটি একটি দুঃস্বপ্ন,’ সুদানে নরওয়েজিয়ান রাষ্ট্রদূত এন্ড্রে স্টিয়ানসেন আলজাজিরাকে বলেছেন। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, বাইরের শক্তিগুলো পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে। এ অবস্থায় ‘স্থিতিশীলতার একমাত্র উপায়… গণতন্ত্রের দিকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উত্তরণ।’
জাস্টিন লিঞ্চ ফরেন পলিসিতে লিখেছেন, ‘সুদানে বর্তমান যুদ্ধের উদ্বেগজনক ঘটনাটি ছিল একটি পুনর্মিলন চুক্তি এবং নিরাপত্তা খাত সংস্কার পরিকল্পনা, যা সুদানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের মিশন দ্বারা চাপানো হয়েছিল। [২০২১ সালে] অভ্যুত্থানের পরপরই… মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ পরিকল্পনাটিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল।’ তিনি যোগ করেন, ‘এটি একটি প্রতিযোগিতা তৈরি করেছিল, যা হেমেদতি এবং বুরহানকে তাঁদের আলাদা বাহিনী গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছিল।’
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা ও হর্ন অব আফ্রিকার সাবেক মার্কিন দূত জেফরি ফেল্টম্যান যুক্তি দিয়েছিলেন, দুই জেনারেল স্থায়ী সমাধানের অংশ হতে পারেন না। ‘সুদানের জনগণ, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সুদানের অখণ্ডতা, সুদানের প্রতিবেশীদের নিরাপত্তা এবং প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির বিষয় হলো, বিদ্রোহীদের মধ্যে আলোচনা এবং আন্তর্জাতিক সমঝোতার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা ভাগাভাগি করা।’ ফেল্টম্যান ওয়াশিংটন পোস্টে আরও লিখেছেন, ‘অন্তত এখন এটি পরিষ্কার হওয়া উচিত– বুরহান এবং হেমেদতি সংস্কারক নন এবং তাঁরা কখনও সংস্কার গ্রহণ করবেন না।’
ইশান থারুর: ওয়াশিংটন পোস্টের বিদেশবিষয়ক কলাম লেখক; ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক