শেরপুরে গারো পাহাড়ে মানুষের বিচরণ বৃদ্ধি ও বনজঙ্গল কমতে শুরু হওয়ায় বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে হাতি। ফলে গারো পাহাড়ের বন্য হাতির জীবন সংকটময়। প্রায়ই নানা ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে গারো পাহাড় থেকে বিলুপ্তির পথে এই প্রাণী। ১৯৯৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩২টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জেলায় মারা গেছে ২৫টি হাতি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার গারো পাহাড়ে বন্য হাতির বিচরণ। ১৯৯৫ সালে ২০-২৫টি বন্য হাতির দল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পিক পাহাড় থেকে দলছুট হয়ে এ পাহাড়ে চলে আসে। পরে এসব হাতির দল ভারতের কাঁটাতারের বেড়া ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধার কারণে আবাসস্থলে ফিরে যেতে পারেনি। ধান ও কাঁঠালের মৌসুম ছাড়াও খাদ্যের সন্ধানে প্রতি রাতেই হাতির দল জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে। সারা বছর দলটি শেরপুরের শ্রীবরদী থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলা পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার সীমান্ত চষে বেড়ায়।
পাহাড়ে হাতির দল খাবার না পেয়ে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। এ সময় পাহাড়িদের বাড়িঘরে হানা দেয়। তখন ফসল ও বাড়িঘর রক্ষা করতে এলাকাবাসী মশাল জ্বালিয়ে ও ঢাকঢোল বাজিয়ে হইহুল্লোড় করে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। মাঝেমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত সড়কের কালভার্টের নিচ দিয়ে হাতির দলটি সীমান্তের ওপারে চলে যায়। কয়েক দিন অবস্থান করার পর ফের গারো পাহাড়ে ফিরে আসে।
এই মানুষ-হাতির দ্বন্দ্বের কারণে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে মানুষ ও হাতি। ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলায় হাতির আক্রমণে এ পর্যন্ত মানুষ মরেছে ৫৮ জন। অপর দিকে হাতি মারা পড়েছে ৩২টি। চলতি বছর হাতির আক্রমণে মানুষ মরেছে ছয়জন। হাতি মারা গেছে একটি।
হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কোনোটাই তেমন কার্যকরী হচ্ছে না বলে দাবি এলাকাবাসীর। ২০১৪ সালে হাতি প্রতিরোধে পরীক্ষামূলকভাবে সীমান্ত এলাকায় ১৩ কিলোমিটার বেড়া (বায়োফেন্সিং) দেওয়ার প্রকল্প নেয় বন বিভাগ। ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় হাতির বিচরণক্ষেত্র ও আক্রমণের সম্ভাব্য গতিপথে এ বেড়া নির্মাণ করা হয়। এ বেড়ায় সৌরবিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়।
২০১৫ সালে ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচি ও কর্নঝুড়া গ্রামে ১০০ হেক্টর বনভূমিতে হাতির খাবারের সংস্থানের জন্য বাগান তৈরি করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া হাতি প্রতিরোধে তাওয়াকুচি, ছোট গজনী, বড় গজনী, হালচাটি ও মায়াঘাসি এলাকায় ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লেবু ও বেতকাঁটার বাগান করা হয়। হাতির অবস্থা দেখতে সীমান্তে ১৬টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়। সেই সঙ্গে হাতি তাড়াতে বিভিন্ন সময় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে চার্জার লাইট, টর্চলাইট ও জেনারেটর বিতরণ করা হয়েছে। বন্য হাতির ক্ষুধার কাছে সব উদ্যোগই ভেস্তে গেছে।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, গারো পাহাড়ে মানুষের অবাধ বিচরণ, বৃক্ষনিধন ইত্যাদি কারণে হাতি অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। যদি গারো পাহাড়ে হাতির অভয়ারণ্য করা যায়, তাহলে এই প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবে। এ ছাড়া তখন লোকালয়েও আসবে না হাতি। ফলে কমে যাবে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ বন বিভাগের প্রধান বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আ ন ম আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘হাতি হচ্ছে প্রকৃতির পাহারাদার। মানুষের প্রয়োজনেই হাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গারো পাহাড়ে হাতির বিচরণ করা এলাকায় অভয়ারণ্য করতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এ পর্যন্ত হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ৯৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আরও ৩৩ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে অর্থ ছাড় করা হয়েছে। আশা করছি এই সপ্তাহে দেওয়া হবে। এরপরও কেউ যেন বন্য হাতিকে বিরক্ত না করেন। হাতি প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ৫০টি দল (এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম) গঠন করা হয়েছে। এখন থেকে এই দলের সদস্যদের সম্মানীও দেওয়া হবে। হাতি ও মানুষের সহাবস্থান সৃষ্টিতে বন বিভাগ গণসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে।’