গাজা অবরোধের নেপথ্যে নির্মম হিসাবনিকাশ ইসরায়েলের

আলজাজিরার বিশ্লেষণ

0
151
সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে রোববার লেবানন সীমান্তের কাছে মেরকাজ ট্যাংক মোতায়েন করেছে ইসরায়েল। ছবি: এএফপি
  • খাদ্য, পানীয় না দিয়ে দমিয়ে রাখার পরিকল্পনা
  • ইহুদিবাদী বাহিনীর পুরোনো সামরিক কৌশল এটি
  • গাজায় প্রতিদিন ৪ হাজার টন ত্রাণ দরকার

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বর্বর হামলার দুই সপ্তাহের মাথায় গত শনিবারের দুটি ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। এর একটি– ফিলিস্তিন ও মিসরের মধ্যে অবস্থিত রাফাহ সীমান্ত গেট দিয়ে ২০টি ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকতে দেয় ইসরায়েল, অপরটি দুই জিম্মিকে হামাসের মুক্তি। কোনো ভূখণ্ড পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রেখে হামলা চালানোর বিষয়টি বহু পুরোনো সামরিক কৌশল। ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ গাজায় সেই কৌশলই এবার খাটিয়েছে ইসরায়েল।

বিশ্লেষকদের মত, সব সময় হামলাকারী শুরুতে প্রতিপক্ষের সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে। প্রতিপক্ষের কাছে যুদ্ধ ও জীবনধারণের রসদ পৌঁছানোর সব রাস্তাও অবরুদ্ধ করে ফেলে। তারা মনে করে, খাবার, পানি, জ্বালানিসহ অন্য সেবা ও সামগ্রীর অভাব, রোগের প্রকোপ ও সার্বিকভাবে মনোবল হারিয়ে প্রতিপক্ষ বাহিনী ও বেসামরিক লোকজন দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে তারা একসময় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।

শুধু এটিই নয়, এখানে আরও একটি মনোভাব রয়েছে হামলাকারীদের। প্রতিপক্ষ দ্রুত আত্মসমর্পণ না করলেও দীর্ঘ সময় অবরোধ ও হামলা অব্যাহত রাখলে প্রতিরোধ ক্ষমতা ও পাল্টা হামলার সক্ষমতা ফুরিয়ে আসবে।

কোনো ভূখণ্ড অবরুদ্ধ করে হামলা চালানো চরম নির্দয় ও নির্মম কাজ। গাজায় এতদিন বাসিন্দাদের অন্তত জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণ হলেও গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর উপত্যকায় সব ধরনের পণ্য প্রবেশ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। তারা পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে গাজার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি এখন পুরোপুরি ত্রাণসহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

প্রাচীনতম আধুনিক অবরোধগুলোর মধ্যে একটি ছিল ১৯৪৮-৪৯ সালের বার্লিন অবরোধ। আর সবচেয়ে কঠোর অবরোধ ছিল ১৯৯০-এর দশকে বসনিয়া এবং আফগানিস্তানে। একই ধরনের হামলা এসব দেশেও হয়েছিল। ওই সময় প্রায় ৪ বছর বসনিয়ার রাজধানী অবরুদ্ধ রেখে হামলা চালায় সার্বরা।

একজন মানুষের বেঁচে থাকতে হলে গড়ে দৈনিক প্রায় ২ হাজার ২০০ ক্যালরি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প সময়ের জন্য প্রায় এক বা বড় জোর দুই মাস একজন মানুষ ১ হাজার ২০০ ক্যালরি পেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের দিনে ১ হাজার ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হতো।

বসনিয়ার মানুষ দৈনিক ৩০০ গ্রাম করে ত্রাণ পেয়েছিলেন এবং ক্যালরির পরিমাণ ছিল দৈনন্দিন চাহিদার অনেক কম। যারা প্রাণে বেঁচেছিলেন, বাকি জীবন তাদের প্রত্যেককেই রুগ্‌ণ ও অসুস্থ অবস্থায় কাটাতে হয়েছে বা এখনও কাটাচ্ছেন।

এ ছাড়া একজন মানুষের তৃষ্ণা মেটানো, রান্না, গোসল ও টয়লেটের জন্য দৈনিক অন্তত ৫ লিটার পানি প্রয়োজন। স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রয়োজন ১০০ লিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরি পরিস্থিতিতে দেড় লিটার পানিতেও জীবনধারণ সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অনেক হিসাব করে চলতে হয়।

বসনিয়া হার্জেগোভিনার মানুষ পর্যাপ্ত নদনদী ও লেকের পানি ব্যবহার করতে পেরেছিল। কিন্তু গাজায় সেই সুযোগ নেই। কারণ, মিঠা পানির উৎস এখানে নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় বলা যায়, গাজার বাসিন্দাদের দৈনিক অন্তত ২ কেজি ত্রাণ প্রয়োজন। প্রায় ২০ লাখ মানুষের জন্য তা দাঁড়ায় দৈনিক ৪ হাজার টন।

এসব ত্রাণ ফিলিস্তিনিদের কাছে পৌঁছানোও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বহির্বিশ্ব থেকে ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে একটি বন্দর শুধু এ কাজের জন্যই ব্যবহার করতে হবে। কারণ, সেখানে প্রতিদিন অন্তত ২টি জাহাজ চলাচল করতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে, রাফাহ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সিনাই শহরে মিসর উপকূলে এ ধরনের একটি বন্দর রয়েছে। বিমানেও কিছু জরুরি সামগ্রী আসা সম্ভব। কিন্তু তাতে গাজার বাসিন্দাদের সব চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.