আমিনুল ইসলামের ঠোঁটে হাসি প্রায় পুরোটা সময়ই লেগে ছিল। একজন করে মঞ্চে আসেন, ব্লেজার পরে ফুল নেন, এরপর সাদা জার্সিতে অটোগ্রাফ দিয়ে দাঁড়ান তাঁর পাশে—তাঁদের ফেরার পথে আমিনুল মজার গল্পে হাসান উপস্থিত সবাইকে, কখনো জানান কৃতজ্ঞতাও। স্মৃতিচারণা, গল্প আর আড্ডায় বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট খেলা ক্রিকেটাররা যেন ফিরে গিয়েছিলেন ২৫ বছরের পুরোনো দিনগুলোতে।
কখনো তাঁদের কথায় চলে আসে বিকেএসপিতে ক্যাম্প করার দিনগুলোর স্মৃতি, কারও কণ্ঠে থাকে দলে ডাক পাওয়ার খবর শোনার সেই সুখের অনুভূতি। সেদিনের প্রধান কোচ সরোয়ার ইমরান মঞ্চে যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানান মেহরাব হোসেন। একটু আগেই কোচের টি–শার্ট চুরির গল্পটা বলে যিনি নিজেও ফেটে পড়েছিলেন অট্টহাসিতে।
এমন অনেক টুকরো টুকরো ছবিতে আজ বিকেলে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ২৫ বছর পূর্তি উদ্যাপনের আয়োজন রঙিন হয়ে ওঠে শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের মিডিয়া প্লাজার সামনের মঞ্চে।

দেশজুড়ে নানা আয়োজনে তা পালিত হয়ে আসছিল সপ্তাহখানেক ধরেই। আজ তা পূর্ণতা পেয়েছে অভিষেক টেস্টের ক্রিকেটারদের পুনর্মিলনীতে। ব্যক্তিগত কারণে যদিও সেখানে থাকতে পারেননি বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের অধিনায়ক নাঈমুর রহমানসহ আকরাম খান, মনজুরুল ইসলাম, আল শাহরিয়ার ও খালেদ মাসুদ।
যাঁরা ছিলেন, লালগালিচার পথ ধরে মঞ্চে হাজির হন তাঁরা। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যেই আমিনুল মনে করিয়ে দেন, কেন তাঁরা সবার চেয়ে আলাদা হয়ে থাকবেন সব সময়, ‘আপনারা ইতিহাস, আপনারা সারা জীবন ইতিহাস থাকবেন।’ কেন ইতিহাস হয়ে থাকা, পরে তা আলাদা করে ব্যাখাও করেছেন আমিনুল। যেটা না করলেও চলত।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রায় সব রেকর্ডই হয়তো একদিন ভেঙে যাবে অথবা নতুন করে লেখা হবে। কিন্তু বাংলাদেশে কেউ চাইলেও তো আর টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম বল খেলা শাহরিয়ার হোসেনকে পেছনে ফেলতে পারবেন না অথবা হাসিবুল হোসেন শান্তর প্রথম বল করার সেই অনুভূতি হবে না আর কারও। ২৫ বছর পরও যে গর্ব থাকল হাসিবুলের কণ্ঠে, ‘বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে প্রথম বলটা আমিই করেছি!’
প্রথম হওয়ার এই অনুভূতি ছুঁয়ে যায় আমিনুলকেও। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা এসেছে তাঁর ব্যাট থেকেই, ‘প্রথমের’ এই অনুভূতি স্পষ্ট তাঁর এ কথাটায়, ‘সবকিছুর প্রথম ছিলাম আমরা। প্রথম অনুভূতি, প্রথম হারা, প্রথম জেতা, প্রথম কষ্টগুলো সহ্য করা। আমাদের হয়তো বোলিং–ব্যাটিং এভারেজ এত স্ট্রং (ভালো) নয়। কিন্তু আপনাদের (প্রথম টেস্ট খেলা ক্রিকেটার) অবদান বাংলাদেশের মানুষ সারা জীবন মনে রাখবে।’

অনুষ্ঠানের শেষে বড় এক কেক এল, তা কাটলেন প্রথম টেস্টে খেলা ক্রিকেটাররা। একত্র হয়ে ক্রিকেটাররা ছবিও তুললেন। কারও কারও হয়তো তখনো ওই ঘটনাটা মনে পড়েছে—বিশাল আয়োজনের ভিড়ে ম্যাচ শুরুর আগে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের যে কোনো গ্রুপ ছবিই তোলা হয়নি! ম্যাচের পর যা তোলা হয়েছিল, তাতে ক্রিকেটাররা ছিলেন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। এবারও ওই অপূর্ণতা ঘুচল না স্কোয়াডের সবাই না থাকায়।
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের স্মরণীয় সব মুহূর্তের ছবিতে সাজানো মঞ্চ। শিশুদের আঁকা ছবি, আর ‘গুডলাক উইশ বোর্ডে’ লেখা শুভকামনাও দাঁড় করানো পাশাপাশি। সামনে পরিচিত সব মুখ। মাহমুদুল হাসানের (অভিষেক টেস্ট খেলার সময় যাঁর নাম ছিল বিকাশ রঞ্জন দাস) মতো কেউ এখন ক্রিকেট থেকে অনেক দূরে, আমিনুলের মতো কেউ বোর্ডের সভাপতি।
তাঁদের সবার একসঙ্গে হওয়ার এই অনুভূতি যেন বারবার হয়, সেই আবদার জানালেন প্রথম টেস্টের একাদশে সুযোগ না পাওয়া জাবেদ ওমর। তাঁদেরকে একসঙ্গে আনার একটা উদ্যোগ অবশ্য বিসিবি নিয়েছে। ক্রিকেটে অনার্স বোর্ড বলতে ৫ উইকেট পাওয়া বা সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটারদের তালিকায় নাম থাকাকেই বোঝানো হয়েছে এত দিন।

আজ শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমের প্রবেশমুখে লাগানো হয়েছে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটারদের একটা ‘অনার্স বোর্ড’, যেখানে বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলা সবার নামই আছে।
প্রথম টেস্ট খেলা খেলোয়াড়দের মিলনমেলার এই দিনে আমিনুল ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আরও একবার। একই আশা দেখিয়েছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াও। ২৫ বছর আগে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর দিনও যেসব ছিল প্রাসঙ্গিক।
অনুষ্ঠানের একদম শেষে আমিনুল শুনিয়েছেন একটা স্বপ্নের কথাও, ‘আমরা পঞ্চাশ বছর পূর্তির যে আয়োজনটা করব, সেটা হয়তো এত ছোট পরিসরে করব না। বেঁচে থাকব কি না, জানি না। তবে আমাদের হয়তো একটা স্টেডিয়াম ভাড়া করতে হবে। তখন আমরা হয়তো ১০০ টেস্ট জয় দেখতে পারব। আমরা অনেক স্বপ্ন দেখছি।’

তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয় কি না, তা জানা যাবে আরও ২৫ বছর পর। তবে আপাতত আজ আমিনুল সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ২৫ বছর আগের ২৬ জুনের স্মৃতিতে—যে দিনটিতে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেয়েছিল!
মাহমুদুল হাসান
ঢাকা