খুলনায় ‘নিখোঁজ’ চার চিকিৎসক কোথায় আছেন, তা এখনো জানেন না তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, ১৮ আগস্ট সিআইডি পরিচয়ে তাঁদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে ওই চিকিৎসকদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি স্বজনদের।
ওই চার চিকিৎসক হলেন শর্মিষ্ঠা মণ্ডল, নাজিয়া মাহজাবিন, মুসতাহিন হাসান ওরফে লামিয়া ও লুইস সৌরভ সরকার। শর্মিষ্ঠা ও নাজিয়া খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক। বাকি দুজন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাঁদের জড়িত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ করা হচ্ছে।
এই চারজন যে কোচিং সেন্টারে মেডিকেল ভর্তির কোচিং করেছিলেন, সেটার উপদেষ্টা চিকিৎসক ইউনুচ উজ্জামান খান ওরফে তারিমকে আটক করেছে সিআইডি। ওই তিন নারী চিকিৎসক ২০১৫ সালে ওই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন। আর লুইস সৌরভ সরকার ছিলেন ২০১২ সালের ব্যাচের শিক্ষার্থী। বর্তমানে লুইস সৌরভ ওই কোচিং সেন্টারের শিক্ষক।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খুলনা বিএমএ ভবনে প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সামনে আসেন নিখোঁজ চার চিকিৎসকের পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের দাবি, তাঁদের সন্তানেরা খুবই মেধাবী। কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ-৫ নিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সত্য নয়। তবে চার চিকিৎসকই থ্রি ডক্টরস নামের একটি মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টারে কোচিং করেছেন বলে স্বীকার করেন তাঁরা।
নাজিয়া মাহজাবিনের মা নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, ১৮ আগস্ট ভোর পাঁচটার দিকে তাঁদের বাড়িতে পাঁচ-ছয়জন লোক ঢোকেন। তখন তাঁর স্বামী নামাজ পড়তে মসজিদে ছিলেন। লোকমুখে শুনে তিনি বাসায় ফেরেন। ওই ব্যক্তিরা তাঁর স্বামীকে জানান, তাঁরা ঢাকার সিআইডি থেকে এসেছেন। নাজিয়া মাহজাবিনকে নিয়ে যাবেন। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই ব্যক্তিরা একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করার জন্য বলেছিলেন। পরে তিনি ওই নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন, তবে কেউ কল ধরেননি। তিন দিন ধরে তাঁদের মেয়ে কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন, তা তাঁরা জানেন না। তাঁরা গত মে মাসে এফসিপিএস সার্জারি প্রথম পার্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
মুসতাহিন হাসান ওরফে লামিয়ার মা ফেরদৌসি আক্তার বলেন, তাঁর মেয়ে খুলনার বেসরকারি সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। ১৮ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে ২০ থেকে ২৫ জন নিরালা আবাসিক এলাকার বাসায় ঢোকেন। তাঁর মেয়ে লামিয়া নাইট ডিউটি করে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলে তাঁকে জোর করে ধরে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর মেয়ের আড়াই বছরের ও সাত বছরের দুটি সন্তান আছে। ছোটটি এখনো মায়ের বুকের দুধ খায়। তিন দিন ধরে মাকে না পেয়ে ছোট সন্তানটি কান্নাকাটি করছে। তাঁরা বহুবার ঢাকা সিআইডি কার্যালয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও সেখান থেকে কিছু জানানো হচ্ছে না।
লুইস সৌরভের মা ম্যাকুলেট সরকার বলেন, ১৮ আগস্ট রাত তিনটার দিকে সিআইডি পরিচয়ে কয়েকজন বাসায় ঢুকে জানতে চান তাঁদের ছেলে কোথায়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে লুইসকে গ্রেপ্তার করতে এসেছেন বলে জানান তাঁরা। এ সময় তাঁদের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাওয়া হলে তাঁরা তা দেখাতে পারেননি। লুইস পাশেই তাঁর মামার বাড়িতে ছিলেন। লুইসের বাবা বাদল সরকারকে নিয়ে তাঁরা মামার বাড়িতে যান। ওই বাড়ি থেকে তাঁর ছেলেকে ধরে নেওয়া হয়। সেই থেকে ছেলে কোথায় আছেন, তাঁরা জানেন না।
শর্মিষ্ঠা মণ্ডলের বাবা দীনবন্ধু মণ্ডল বলেন, ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাঁর বাড়িতে যান একজন নারীসহ চারজন। তখন তাঁর মেয়ে ঘুমিয়েছিলেন। সিআইডি পরিচয়ে তাঁরা মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যান। কেন ও কী কারণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার কিছুই তাঁদের জানানো হয়নি। ঢাকা সিআইডি কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, তাঁর মেয়ে সেখানে আছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনা জেলা শাখার নেতারা বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। ওই ব্যাপার নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই। ওই চিকিৎসকেরা যদি এর সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁরাও চান তাঁদের শাস্তি হোক। তবে তিন দিন পেরিয়ে গেলেও কারও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাপারটি খুবই উদ্বেগের।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক নিয়াজ মুস্তাফী চৌধুরী বলেন, নিখোঁজ চার চিকিৎসকের মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক আছেন। কিন্তু তিন দিন তাঁর নিখোঁজ থাকার বিষয়টি পরিবারের পক্ষ থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি।