কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোয় প্রায়ই গোলাগুলি, সংঘর্ষ ও খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরেএসও) মধ্যে এই লড়াইয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আশ্রয়শিবিরে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয়শিবির পরিদর্শনে আসছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আজ মঙ্গলবার দুই দিনের সরকারি সফরে কক্সবাজার আসছেন আইজিপি। উখিয়ার আশ্রয়শিবির পরিদর্শনের পাশাপাশি সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর বৈঠক করার কথা রয়েছে।
সাধারণ রোহিঙ্গা ও আশ্রয়শিবিরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করছেন, পুলিশপ্রধানের এই সফরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নতুন নির্দেশনা আসতে পারে। আশ্রয়শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ অভিযান শুরুর আশা করছেন কেউ কেউ।
আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, পুলিশপ্রধান কাল বুধবার সকালে উখিয়ার কয়েকটি রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠকে আশ্রয়শিবিরের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
যৌথ অভিযানের ঘোষণা প্রসঙ্গে এপিবিএনের অধিনায়ক বলেন, আশ্রয়শিবিরগুলোয় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান। অস্ত্রশস্ত্রসহ বহু সন্ত্রাসী ধরাও পড়ছে। তারপরও নতুন কিছু নির্দেশনা আসতে পারে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
গোলাগুলি-সংঘর্ষে ৫ মাসে নিহত ৪০
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত পাঁচ মাসে আশ্রয়শিবিরগুলোয় একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ১০ জন আরসা, ১ জন স্বেচ্ছাসেবক ও অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা।
পুলিশ জানায়, সর্বশেষ গত রোববার (৩০ এপ্রিল) ভোরে উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১) ডি ব্লকে আরসা সন্ত্রাসীদের গুলিতে আবদুর রশিদ নামের এক রোহিঙ্গা নেতা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তিনি আরএসও–সমর্থক। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গত ১৫ এপ্রিল বিকেলে আরসার সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৩) রোহিঙ্গা নেতা রওশন আলীকে (৫৫)। তিনি ওই আশ্রয়শিবিরের ই-২ ব্লকের সাব-মাঝি (নেতা) ছিলেন।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে উখিয়ার কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে পাঁচটি পৃথক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় দুজন আরসা সন্ত্রাসীসহ পাঁচজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হয় এক রোহিঙ্গা। গত মার্চ মাসে কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে ১০টি পৃথক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয় এক শিশুসহ চার রোহিঙ্গা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক রোহিঙ্গা নেতা জানান, সন্ধ্যা নামার পরপরই আশ্রয়শিবিরগুলোয় আরসা, আরএসও সহ একাধিক গোষ্ঠী অস্ত্রের মহড়া দেয়। আধিপত্য বিস্তারে সন্ত্রাসীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
উখিয়ার কুতুপালং, মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, বালুখালীসহ বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিসহ আটজন সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। বার্মিজ ও ইংরেজি ভাষায় লেখা পোস্টারে আরসা সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিলে লাখ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। এর আগে মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনকে ধরিয়ে দিতে পোস্টার লাগানো হয়েছিল। গত বছরের মার্চে নবী হোসেনকে ধরিয়ে দিলে ১০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে পোস্টার সেঁটেছিল কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে নবী হোসেন।
গত এক বছরে ১৪ এপিবিএন উখিয়ার বালুখালীসহ কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে ৭টি বিদেশি পিস্তল, ৩০টির বেশি ওয়ানশুটার গানসহ বিপুল গোলাবারুদসহ অন্তত পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু আরসা, আরএসও, নবী হোসেন বাহিনীর মূল হোতারা থেকেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সন্ত্রাসীদের ধরতে এখন যৌথ অভিযান দরকার বলে মনে করছে সাধারণ রোহিঙ্গারা।
১৪ এপিবিএন অধিনায়ক সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ আরসার কয়েক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মূল হোতারা মিয়ানমার সীমান্তে, কিছু টেকনাফের গহিন অরণ্যে অবস্থান করায় ধরা সম্ভব হচ্ছে না।
আশ্রয়শিবিরে সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে পোস্টার সাঁটানো প্রসঙ্গে এপিবিএনের অধিনায়ক বলেন, এগুলো আরসা ও আরএসওর লোকজন করছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
পুলিশ জানায়, আজ দুপুরে পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, সরকারি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
৩ মে সকালে কক্সবাজার শহর থেকে সড়কপথে যাবেন ৬৫ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে। সেখান থেকে আরও কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে পরিদর্শন শেষে দুপুরে সেখানকার এপিবিএনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। বিকেলে শহরে ফিরে এসে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে কক্সবাজারে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা রয়েছে তাঁর।