ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশের অনুসন্ধানী দলের হয়ে থানচির একটি জলপ্রপাতের তথ্য সংগ্রহ করতে বান্দরবান এসেছি। এবার শুধু ট্রেকিং নয়, উঁচু একটি জলপ্রপাতের ওপর থেকে র্যাপেল করে আমরা নিচেও নামব।
ধুলায় ধূসরিত মাটির রাস্তা ধরে প্রচণ্ড তাপ মাথায় নিয়ে তিন্দু হয়ে রাত আটটার দিকে পৌঁছালাম পাও-অ। এটা একটি খুমিপাড়া। রাতে কারবারি দাদার ঘরে পাড়ার মুরব্বিদের সঙ্গে গল্প করে জলপ্রপাতটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম। যে ঝিরিটি প্রপাত হয়ে নিচে পড়েছে, সেখানে ছোট একটি বাদুড়গুহা আছে। মারমা ভাষায় বাদুড়কে বলে লাংলোক, ঝিরি আর প্রপাতটাকেও তাই ওই নামেই ডাকা হয়।
পরদিন সকাল থেকেই আমাদের কাজ শুরু হলো। উচ্চতা মাপার জন্য আমাদের প্রপাতের পতনস্থলে যেতে হবে। পাড়া থেকে সব সরঞ্জাম নিয়ে ঝিরিতে নেমে পড়লাম। দুটি ছোট ঝিরি পেরিয়ে আমরা মূল ঝিরিতে গিয়ে নামলাম। বড় বড় পাথর পানির অভাবে জেগে উঠেছে। দুই দিকের পাহাড় খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে। পুরো ঝিরিপথটুকু বিশাল বিশাল বৃক্ষ দিয়ে ছেয়ে আছে বলে সূর্যের আলো এখানে প্রবেশ করে না। খুব সাবধানে এগোতে এগোতে একসময় আমরা জলপ্রপাতের ঠিক মুখের কাছে এসে পড়লাম।
খাদের একেবারে কিনারে এসে পা দুটো আপনাআপনি থমকে গেল। পুরো আকাশ যেন আমার সামনে নিচে নেমে এল। বুকের ভেতর তখন ধড়াস ধড়াস করে আদিম উত্তেজনা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। খাদের নিচে কী আছে, দেখার জন্য একটু ঝুঁকে দাঁড়ালাম। অতল শূন্যতা পেরিয়ে চোখ আটকে গেল নানা আকারের পাথরের চাঁইয়ের দিকে। আমি তখন বাস্তবিক অর্থেই একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি! চোখের সামনে হাজারও ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। মনে হলো কেউ যেন আমাকে হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরের রাজ্য প্যান্ডোরায় পৌঁছে দিয়েছে।
আমি যখন এসব আকাশপাতাল ভাবছি, তখন অ্যাংকর করার জন্য শক্তপোক্ত গাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে ইন্তিয়াজ। অ্যাংকরের জন্য আমাদের পাশাপাশি কমপক্ষে দুটি শক্ত গাছ লাগবে। দুটি গাছে রশি দিয়ে গিঁট দিলে সেখানে ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের আকার নেবে। এভাবে অ্যাংকর করলে ভার দুটি গাছেই সমানভাবে বণ্টন হয়ে যাবে। কোনো একটি গাছের ওপর বেশি চাপ পড়বে না। দুর্ঘটনাবশত যদি ক্লাইম্বারের অবাধ পতন (ফ্রি ফল) হয়েও যায়, তাহলেও হঠাৎ করে দড়ির ওপর পড়া চাপ সহজেই এই অ্যাংকর মানিয়ে নিতে পারবে।
ঠিক পাশাপাশি না হলেও সামনে পেছনে মিলিয়ে ইন্তিয়াজ আর মুনীম অ্যাংকর করে প্রধান দড়িটি ঝুলিয়ে দিল। এই দড়ি ধরেই এবার আমরা এক এক করে লাংলোক জলপ্রপাতের ওপর থেকে নিচে র্যাপেল করে নেমে যাব।
আগে কখনোই কেউ এই জলপ্রপাতের উচ্চতা নির্ণয় করেনি। নিচ থেকে এই বিশালাকার জলপ্রপাতটিকে দেখে এর উচ্চতা সম্পর্কে শুধু ধারণাই করা যায়। প্রাথমিকভাবে খালি চোখের আন্দাজে ধারণা করেছিলাম, উচ্চতা ৩০০-৩৫০ ফুট হবে। সেই হিসাব করে আমরা ২০০ ফুটের দুটি দড়ি নিয়ে এসেছি। সঙ্গে ছিল আরেকটি ৫০ ফুটের বাড়তি দড়ি। কিন্তু আন্দাজের ওপর নির্ভর করে তো এত ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার করা যায় না।
তাই জলপ্রপাতটির উচ্চতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার জন্য ওপর থেকে বড় একটি পাথর ফেলে দিলাম। ১২ সেকেন্ড পর পতনের শব্দ পাওয়া গেল। অভিকর্ষ ও পতনকাল থেকে ধারণা পেলাম উচ্চতা ৩৮০ ফুটের কাছাকাছি হবে। এরপর আমরা ব্রুট ফোর্স মেথডে এর উচ্চতা পরিমাপ করলাম। লম্বা একটি রশিতে ওজন বেঁধে প্রপাতের ওপর থেকে ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে দিলাম। ফল লাইন যেন সমান থাকে ও দড়ি যেন কোথাও আটকে না যায় এবং পানি ঠিক যেখানে স্পর্শ করে, সেখান পর্যন্তই যেন দড়িটি পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা পাশ দিয়ে একটি র্যাপেল লাইন সেট করে ফেলি।
ক্যানিওনিং
প্রপাতের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত র্যাপেল করে নামার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো তার আকার ও আকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া। এখান থেকে শুরু হলো আমাদের অভিযানের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। এখন থেকে প্রতিটি কাজ খুবই ঠান্ডা মাথায় মনোযোগের সঙ্গে করতে হবে। গাফিলতির কোনো সুযোগ এখানে নেই।
অ্যাংকর সেট করে, সব সাজসরঞ্জাম পড়ে ইন্তিয়াজ যখন সবার প্রথমে নামা শুরু করল, তখন পর্যন্ত আমরা সবাই একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। সবকিছু ঠিক আছে তো, কোথাও কোনো ভুল হয়ে যায়নি তো? এ ধরনের চিন্তাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সবার আগে র্যাপেল লাইন চেক করার জন্য ইন্তিয়াজ এগিয়ে গেল। হারনেস, হেলমেট, ক্যারাবিনা, ডিসেন্ডার ও বিশেষ প্রয়োজনের জন্য সঙ্গে এক সেট জুমারও নিয়ে নিল। বাংলা চারের মতো দেখতে ডিসেন্ডারটি তাঁর কোমরে লাগানো দড়িতে গলিয়ে খাদের বাইরে চলে গেল। এরপর লম্বা একটি শ্বাস নিয়ে সে প্রথম লাফটি দিয়ে তরতর করে নিচে নেমে খাদের কিনারে হারিয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর কমলা একটি অবয়ব যখন নিরাপদে নিচে নেমে যেতে দেখলাম, তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। একে একে মুনীম, অনীক, সন্দীপ, শামীম রুটিনওয়ার্কের মতো র্যাপেল করে নেমে গেল।
অতঃপর আমার পালা। জীবনে এত এতবার র্যাপেল করেছি, উঁচু উঁচু টাওয়ার থেকে দড়ির ওপর সমস্ত আস্থা রেখে নেমে গেছি, তারপরও যখন পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ালাম, উত্তেজনায় বুকটা ডিব ডিব করতে লাগল। শেষ মুহূর্তের শঙ্কা—দড়িটি ছিঁড়ে যাবে না তো? পরক্ষণেই চিন্তা দূর হয়ে গেল। নিয়মমাফিক দুই হাঁটু ভাঁজ করে জলপ্রপাতের দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে গেলাম আর একই সঙ্গে বাঁ হাতে ধরে থাকা সেফটি লাইনটিতে ঢিল দিতেই সরসর করে খানিকটা নেমে এলাম। অভিকর্ষের টানে শরীর দেয়ালের কাছে চলে যেতে আবারও দুই পা দিয়ে ধাক্কা, আবারও দড়িতে ঢিল দেওয়া আর নেমে যাওয়া। ৩০-৪০ ফুট নামার পরই দেয়াল শেষ হয়ে যায়। জলপ্রপাতটি একেবারে খাড়া হয়ে নিচে নামেনি। ২০ ফুটের মতো খাড়া নামার পর দেয়াল ভেতর দিকে অবতল আকার নিয়েছে। মাঝামাঝি স্থানে পানিপ্রবাহের ফল লাইন থেকে দেয়ালের দূরত্ব প্রায় ৪০ ফুটের মতো। মাঝ-আকাশে ভাসতে ভাসতে দেয়ালের গায়ে বাসা বাঁধা নেপালি হাউস মার্টিন পাখির বাসাগুলো দেখলাম। মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে আকাশে ভেসে আছি। একসময় দড়ির শেষ প্রান্ত ধরে নিরাপদে নেমে আসি। শেষ হয় আমার লাংলোক ক্যানিওনিং।