ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে ৪৬ নাগরিকের বিবৃতি

0
3
রাজধানীর মতিঝিলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মশালমিছিল বের করে ‘সংক্ষুব্ধ ছাত্র–জনতা’

পাঠ্যবই থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় ৪৬ নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে এ ঘটনায় তাঁরা ক্ষোভ ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গতকাল (বুধবার) জেনেছি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) তাদের একটি বইয়ের পেছনের পৃষ্ঠায় বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আঁকা আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি যথাযথ মর্যাদায় ব্যবহার করে আবার তা প্রত্যাহার করে। প্রতিবাদে ‘আদিবাসী’ শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের একটি দল শান্তিপূর্ণভাবে এনসিটিবি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের ওপর হিংস্র¯আক্রমণ চালায়। ২০ জনের বেশি ‘আদিবাসী’ শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ থেকে অন্তত ১৫ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। কয়েকজনকে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনে অন্য বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়েছে।

ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হওয়ার কথা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হামলার আগের দিন থেকে হামলাকারীরা তাদের সহিংস আক্রমণের পরিকল্পনার ইঙ্গিত ঘোষণার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সুরক্ষায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি হামলা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যকে দূরে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে দেখা গেছে।

ওই হামলার দায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অন্য কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন না জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, একটি সংগঠনের ব্যানারে একদল সন্ত্রাসী ‘আদিবাসী’-বিরোধী বিক্ষোভের মুখে সম্প্রতি নবম-দশম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সনে থাকা ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি সরিয়ে নতুন গ্রাফিতি যুক্ত করেছে এনসিটিবি, যা একটি অগ্রহণযোগ্য ও অনৈতিক কাজের দৃষ্টান্ত। ওই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দাবি ছিল সংবিধানে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার নেই, তাই শব্দটি প্রত্যাহার করতে হবে। কোনো বিশেষ মহলের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে, কোনো গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যমূলক বিক্ষোভের অজুহাতে দায়িত্বশীল সরকারি সিদ্ধান্ত রাতারাতি বদলানোর এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্তের ধিক্কার জানাই।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, জুলাই অভ্যুত্থানে দেড় হাজারের বেশি প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছিল। সেই বিজয়ের পর নতুন উদ্যমে দেশ গঠনে শপথ নিয়েছিল দেশের তরুণ প্রজন্ম। আন্দোলন চলাকালে এবং স্বৈরশাসকের পতনের পরেই দেশের বিভিন্ন দেয়ালে আঁকা হয় আন্দোলনের গৌরবময় গ্রাফিতি। একটি প্রজন্মের আহ্বান, প্রত্যাশা ও স্বপ্নের স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকারের সাক্ষী এসব গ্রাফিতি। বাংলাদেশ যে বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদ, বহু ধর্ম, বহু ভাষা, বহুমতের দেশ—এসব বার্তা অসংখ্য গ্রাফিতিতে ছিল। পাঠ্যবই থেকে যে গ্রাফিতি বাদ দেওয়া হয়েছে, তাতেও ওই বার্তাই ছিল। যে গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদের মুখোশ জনসমক্ষে উন্মোচন করতে হবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণে তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন। যাঁরা পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি সরিয়েছেন, তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান ও অঙ্গীকারকে অসম্মান করেছেন বলে আমরা মনে করি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বৈষম্যবিরোধী এ সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বহাল রাখবে।’

বিবৃতিতে নাগরিকেরা ছয়টি দাবি জানিয়েছেন, যা হচ্ছে—‘আদিবাসী’ জাতিগোষ্ঠীর নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় দ্রুত উচ্চপর্যায়ে নিরপেক্ষ তদন্ত ও হামলায় যুক্তদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। হামলার পেছনে মদদদাতা সক্রিয় গোষ্ঠীকে দ্রুত শনাক্ত করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসীদের’ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত অধ্যায় যুক্ত, ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি প্রত্যাহারের ঘটনায় এনসিটিবিকে ক্ষমা চাওয়া ও গ্রাফিতি পুনঃস্থাপন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীরবতার ব্যাখ্যা দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল, নিজেরা করি–এর সমন্বয়কারী খুশী কবির, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী, আরআইবির নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, আলোকচিত্রী ও লেখক শহিদুল আলম, বেলার প্রধান নির্বাহী (ভারপ্রাপ্ত) তাসলিমা ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, সাংবাদিক ও গবেষক সায়দিয়া গুলরুখ, আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা এবং স্পার্কের প্রতিষ্ঠান নির্বাহী পরিচালক মুক্তাশ্রী চাকমাসহ আরও ২৬ বিশিষ্ট নাগরিক।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.