রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রায় ৯০ শতাংশ নিজে দোকানের মালিক নন। অন্যের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতেন তাঁরা। অগ্নিকাণ্ডে মূলত তাঁরাই সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন। সেসব ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীকে নয়, কাগজে-কলমে যাঁরা দোকান মালিক, তাঁদেরই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
সিটি করপোরেশনের বাজার শাখার কর্মকর্তা ও মার্কেটের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তাঁরা জানান, বঙ্গবাজারে বরাদ্দপ্রাপ্ত দোকান মালিকরা সেখানে খুব একটা ব্যবসা করেন না। তাঁদের কাছ থেকে ১০-১৫ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে ও মাসিক ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করতেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। তাঁদেরই পণ্যসামগ্রী পুড়ে ছাই হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কাগজ-কলমে তাঁদের নাম-গন্ধ নেই। যাঁদের নামে দোকান বরাদ্দ আছে, তাঁদেরই ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে মনে করছে করপোরেশন। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে এ রকম দোকান মালিক আছেন ২ হাজার ৯৬১ জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদেরও কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়, সে পথও খোঁজা হচ্ছে। তাঁরাও ক্ষতিপূরণ পাবেন। স্বচ্ছ একটা নিয়মের মধ্য দিয়েই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া খোঁজা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাগজ-কলমের চেয়ে আরও অনেক বেশি দোকান গড়ে তুলেছিলেন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকান মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ, ডিএসসিসির অসাধু কিছু কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একটি চক্র। সেগুলো ভাড়া দিয়ে চক্রটি বিশাল ফায়দাও লুটেছে। অগ্নিকাণ্ডে সেই সব অবৈধ দোকানও পুড়েছে। ওই সব দোকান মালিকের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। ফলে তাঁদের জন্য কোনো সহযোগিতা করতে আগ্রহী নয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছে। কিন্তু এখন ডিএসসিসি কেবল বৈধ ব্যবসায়ীদের চৌকি পেতে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এ জন্য তাঁদের ১৭ বর্গফুটের জায়গা নির্ধারণ করে দেবে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ১ হাজার ৬০ টন বর্জ্য অপসারণ করেছে ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও যান্ত্রিক সার্কেল। তার পরও সেখানে বাতাসে রয়েছে আগুনের গন্ধ। ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ১ দশমিক ৭৯ একর জায়গায় বালু ফেলে ইট বিছানোর কাজ চলছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৪০ গাড়ি বালু ফেলে ৯০ হাজার ইট বিছানোর কাজ শেষ হয়েছে। পুরো জায়গার জন্য মোট বালু লাগবে ১৫০ গাড়ি। ইট আড়াই লাখ। আজই তালিকা ধরে পর্যায়ক্রমে মূল দোকান মালিকদের জায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। অনুমোদনহীন দোকানিদের কোনো জায়গা ওই নির্দিষ্ট স্থানে হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির বাজার সার্কেলের এক কর্মকর্তা বলেন, ওই মার্কেটে অনেক সরকারি আমলা, বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, কাউন্সিলর এমনকি এমপিরও নামে-বেনামে দোকান আছে। তাঁরা কেউই ওই মার্কেটে ব্যবসা করেন না। কাগজে-কলমে তো ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ডিএসসিসি তাঁদেরই পাচ্ছে। তাহলে তো ক্ষতিপূরণ তাঁদেরই প্রাপ্য। আরেক কর্মকর্তা জানান, দোকান মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সেই ৪ হাজার ২০০ জনের তালিকা দিয়েছেন। পাশাপাশি অন্যান্য মার্কেটের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা দিয়েছেন। এ রকম ৭-৮ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকের তালিকা পাওয়া গেছে। ওই তালিকার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ অবস্থায় ডিএসসিসি তাদের তালিকা ধরেই এগোবে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেটের হকারদের পুনর্বাসনের জন্যই গুলিস্তানে ছয়তলা ঢাকা ট্রেড সেন্টার তৈরি করা হয়। সেখানে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের অনেক ব্যবসায়ী দোকান পান। কিন্তু তাঁরা বঙ্গবাজারের দোকান ছাড়েননি। ফলে যিনি দোকানের মালিক ছিলেন, তিনি আরও দোকানের মালিক হয়েছেন। এতে মূল হকাররা ফুটপাতেই রয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মুখপাত্র আবু নাছের বলেন, এই মুহূর্তে ডিএসসিসির তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ীরা দ্রুতই যাতে চৌকি পেতে ব্যবসা শুরু করতে পারেন, সেই চেষ্টা চলছে। এই কাজ শেষ হলে তখন অন্য বিষয়গুলোও পর্যায়ক্রমে দেখা হবে।
সিগারেট-কয়েলে আগুনের সূত্রপাত : বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত আট সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গতকাল ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে উপস্থাপন করা হয়। এতে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে মশার কয়েল বা সিগারেটের আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সেখানে মশার প্রচণ্ড উৎপাত ছিল। এ জন্য অনেকেই মশার কয়েল ব্যবহার করত। বঙ্গবাজার আদর্শ মার্কেটের তৃতীয় বা চতুর্থ তলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে বলে তদন্ত কমিটির অভিমত। চতুর্থ তলায় নিরাপত্তাকর্মীরা থাকতেন। সেহরির পর হয়তো কেউ ধূমপান করে থাকলে তা পা দিয়ে নেভাতে গেলে কাঠের পাটাতনের ফাঁক দিয়ে তিনতলায় পড়ে যেতে পারে। সেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়ার যাবতীয় অনুকূল পরিবেশ ছিল। আর সাক্ষ্যদাতাদের কাছ থেকে তিন বা চতুর্থ তলাতেই আগুনের সূত্রপাত হিসেবে পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় তলার অ্যামব্রয়ডারি টেইলার্সকে কেন্দ্রস্থল হিসেবে উল্লেখ করেছে কমিটি।
ক্ষতির পরিমাণ ৩০৩ কোটি : অগ্নিকাণ্ডে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার কথা উল্লেখ করেছে কমিটি। আর পণ্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২২২ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ কমিটি ১০টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– ডিএসসিসি এলাকায় কোনো কাঠের বা টিনশেড মার্কেট না রাখা। কংক্রিট বা পাকা ভবন তৈরি করা। পর্যাপ্ত অগ্নিনিরোধক সামগ্রী রাখা। মার্কেটগুলোর ভেতরে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা সংরক্ষণ, আধুনিক বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ওয়াটার রিজার্ভার রাখা, নগরীতে জলাধার নিশ্চিত করা।
অমিতোষ পাল