ক্যাশলেস সমাজের গতি ও গন্তব্য

0
120
তানভীর এ মিশুক

ধরা যাক, সালটা ২০২৮। নিঝুমদ্বীপের এক গ্রামে সকাল বেলা ধানের ক্ষেত দেখতে বেরিয়েছেন কৃষক সামাদ উদ্দিন। বাতাসে দোল খেতে থাকা সবুজ ধান দেখে তাঁর মনটা ভালো হয়ে গেল। একই সঙ্গে দুশ্চিন্তা কিছু পাতার হলুদ হয়ে যাওয়া দেখে; ক্ষেতে সার দেওয়া দরকার। সমস্যা হলো, পকেটে একদম টাকা নেই। পকেট থেকে ফোনটা বের করে নগদ-এ ১০ হাজার টাকা ঋণের আবেদন করলেন কয়েকটা বাটন চেপে। কয়েক মিনিটের অপেক্ষা। ক্রেডিং রেটিং ব্যবস্থা তাঁর আবেদন বিচার করে ওয়ালেটেই পাঠিয়ে দিল ১০ হাজার টাকা। সার নিয়ে ফিরলেন সামাদ। ভ্যান ভাড়া দিতে হবে। মোবাইল ফোন বের করে ভ্যানের সামনে লাগানো কিউআর কোড স্ক্যান করে টাকাটা দিয়ে দিলেন।

আপাতত গল্পটা একটু দূরের মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ক্যাশ টাকা এভাবে প্রায় ‘নেই’ করে দেওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের মতো অনেকেই এ ক্ষেত্রে কাজ করছেন। চার বছরের যাত্রায় নগদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই আশাবাদের কথাগুলো বলছি।

এখন এটাকে স্বপ্ন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে মানুষের হাতের মোবাইল ফোনই হয়ে উঠবে তার ব্যাংক; ঋণ পাওয়ার আশ্রয়, তার যাবতীয় লেনদেনের মাধ্যম। এমনকি ‘বাই নাউ পে লেটার’ প্যাকেজের মাধ্যমে এখন কিনে পরে টাকা দেওয়ারও মাধ্যম হয়ে উঠবে। এই ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত নগদ।

চার বছর আগেও মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা বলতে শুধু টাকা লেনদেনকেই বোঝাত। ফরম পূরণের পরও অ্যাকাউন্ট খুলতে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকতে হতো। সে চিত্র ইতোমধ্যে বদলে গেছে। মোবাইল ফোন এখন যাবতীয় লেনদেনের প্রধান মাধ্যম।

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা থেকে শুরু করে শিক্ষা উপবৃত্তি এখন বিতরণ হচ্ছে মোবাইল ফোন ওয়ালেটে। ঘরে বসে একজন বিধবা, প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যক্ত– সবাই যাঁর যাঁর সরকারি ভাতা পেয়ে যাচ্ছেন। আর এই বিপ্লবের অন্যতম কারিগর ‘নগদ’। করোনার সময় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার বিতরণের মাধ্যমে আসলে এই কাজটা গতি পায়। এর পর থেকে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার ৭৫ শতাংশ এবং শিক্ষা উপবৃত্তি শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে বিতরণ করেছি আমরা। এর ফলে সঠিক মানুষের হাতে ভাতা পৌঁছানো, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সরকারের বিপুল অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।

ক্যাশলেস সোসাইটি বিনির্মাণে সাফল্যের পেছনে ছিল প্রযুক্তির অবদান। একটা সময় ব্যাংক বা এমএফএসে অ্যাকাউন্ট খোলা মানেই ছিল এক গাদা কাগজ পূরণ; ছবি, আইডি কার্ড নিয়ে ছোটাছুটি নিত্যকার ঘটনা। ইলেক্ট্রনিক কেওয়াইসি প্রচলনের ভেতর দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা এখন কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপারে পরিণত করা গেছে। এই প্রযুক্তি বিপ্লব এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক খাতে। এখন তো সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজের গতি বাড়িয়েছে, যা আসলে আর্থিক প্রবাহকে বাড়তি গতি দিয়েছে।

ই-কেওয়াইসির পাশাপাশি মোবাইল ফোনের মাত্র কয়েকটা বাটন চেপেই অ্যাকাউন্ট খোলার প্রচলনও কিন্তু আরেকটা উদ্ভাবন। সামনের দিনে এই উদ্ভাবন আরও অনেক অচলায়তন ভেঙে দিতে পারে।

উদ্ভাবন দিয়ে শুধু আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ালেই হবে না। লেনদেন গতিশীল করার পাশাপাশি সেটি নিরাপদ করাও তো বড় দায়িত্ব। সেখানেও চমক জাগানো উদ্ভাবন হলো নম্বর গোপন রেখে লেনদেন করা। এই পদ্ধতি নিশ্চিতভাবেই সাধারণ মানুষ বিশেষত নারীর হয়রানি হ্রাস করবে।

আমরা জানি, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং, মাইক্রো ফিন্যান্সিংয়ের ওপর জোর দিচ্ছে। এ দুটো করতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজেন্সের ওপর জোর দিতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ বলি আর ‘বাই নাউ আর পে লেটার’ বলি না কেন; এর পুরোটাই দাঁড়াবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজেন্সের ওপর। যেসব মানুষ আগে আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাঠামোতেই ছিলেন না, তাঁদের মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা ব্যবহারের ধরনের ওপর ক্রেডিং রেটিং দেখে আবেদনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিতরণ করে দেওয়া হবে ঋণ। তা ছাড়া ক্ষুদ্র লেনদেন এবং কেনাকাটাও অনেক শক্তিশালী হবে সামনের দিনে। ফলে রিকশা ভাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে ভ্যানের সবজির দাম পরিশোধ; সবই হবে ছাপা মুদ্রার ব্যবহার ছাড়াই। ব্যবসায়িক লেনদেন বা গ্রাহক থেকে ব্যবসায়ীর লেনদেন অগ্রসর করতে পারলে তা আমাদের অর্থনীতিকে দেবে আরও গতিশীলতা।

সব মিলিয়ে আমাদের জন্য স্বপ্নের মতো একটা অর্থনৈতিক কাঠামো অপেক্ষা করছে। পুরো দেশ একটি ক্যাশলেস সোসাইটিতে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায়। আর এ জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ‘নগদ’।

তানভীর এ মিশুক: মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান নগদ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.