দালানের বাসিন্দারাও কেনেন মুন্সিগঞ্জের টিনের ঘর, রিসোর্ট-রেস্তোরাঁ বানাতেও বেড়েছে চাহিদা

0
117
কাঠ-টিনের নকশাখচিত নান্দনিক ঘর বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকেরা। এ ধরনের ঘরের কদর দিন দিন বাড়ছে। গত বুধবার বিকেলে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কাঠপট্টি কলাবাগান ঘরের খোলায়

নদীভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সহজে সরিয়ে নেওয়া যায়, এমন কাঠ-টিনের ঘরের প্রচলন মুন্সিগঞ্জের পদ্মাপাড়ে দীর্ঘদিন ধরেই। কয়েক বছর আগেও ‘রেডিমেড’ এসব ঘর শুধু স্থানীয়ভাবে বিক্রি হতো, তবে নান্দনিক সৌন্দর্যের কারণে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। দৃষ্টিনন্দন রিসোর্ট-রেস্তোরাঁ করার জন্যও এসব ঘর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা।

গত বুধবার বিকেলে লৌহজং উপজেলার কাঠপট্টি কলাবাগান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নান্দনিক এসব ঘর তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ। যন্ত্র ও হাতের সাহায্যে কাঠের নকশা ফুটিয়ে তুলছেন শ্রমিকেরা। তাঁদের হাতুরি পেটা ঠুকঠাক শব্দে মুখর পুরো এলাকা।

কলাবাগান এলাকার মেসার্স সেফালী টিম্বার টিলার্সে প্রবেশ করতে দেখা গেল, একতলা ও দোতলা কয়েকটি টিনের ঘর। ঘরের দরজা, জানালা, বেড়া, টুয়া, চাল, ভেতরে-বাহিরে সব কিছুতেই নকশা করা কারুকাজ। ঘরগুলো দেখলেই আটকে যায় চোখ। দৃষ্টিনন্দন এসব ঘর তৈরি হয়েছে কাঠ, টিন, প্লেন শিট দিয়ে।

সেফালী টিম্বার টিলার্সের মালিক আবদুর রব ব্যাপারী ছোট থেকে ঘরের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি বলেন, তিন বছর ধরে ঘরের চাহিদা বেড়েছে। আগে মাসে চার থেকে পাঁচটি ঘর বিক্রি হতো। বর্তমানে ১০ থেকে ১২টি ঘর বিক্রি হচ্ছে। ঘর তৈরি করে রাখা যাচ্ছে না। ক্রেতারা দরদাম করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ঘর তৈরির জিনিসপত্রের দাম বেশি, লাভ কম হচ্ছে। তারপরও বিক্রি বেশি হওয়ায় খুব ভালো আছেন।

একেকটি ঘর নির্মাণ করতে ৫ থেকে ১০ জন শ্রমিকের সময় লাগে ৪ থেকে ৫ দিন
একেকটি ঘর নির্মাণ করতে ৫ থেকে ১০ জন শ্রমিকের সময় লাগে ৪ থেকে ৫ দিন

লৌহজং উপজেলার কাঠপট্টির কলাবাগান এলাকার ব্যবসায়ীরা বংশপরম্পরায় এসব কাঠের ঘর তৈরি করে আসছেন। এ ছাড়া মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগীনি, ধলাগাঁও, আলদি, টঙ্গিবাড়ি উপজেলার বেতকা, পাইকপাড়া, সিরাজদিখানের মালখানগরে ঘরের ব্যবসা রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাইজেরিয়ান কাঠ দিয়ে বেশির ভাগ ঘরগুলো তৈরি করা হয়। এ ছাড়া সেগুন, শাল, বাচালু ও ওকান কাঠের ঘরের চাহিদাও রয়েছে। এসব ঘরে বেড়া ও চালের জন্য ৩০, ৩২, ৪৮ মিলিমিটারের টিন ব্যবহার করা হয়। কখনো বেড়ার নকশার কাজে টিনসেড ব্যবহার করা হয়। একেকটি ঘর নির্মাণ করতে ৫ থেকে ১০ জন শ্রমিকের সময় লাগে ৪ থেকে ৫ দিন। টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা ঘরগুলোয় পর্যাপ্ত আলো–বাতাস পাওয়া যায়।

বিক্রেতারা বলছেন, মানসিক প্রশান্তি আর নান্দনিক নকশার কারণে মুন্সিগঞ্জসহ শরীয়তপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, ঢাকা, গাজীপুর, বরিশাল, নোয়াখালী, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতারা এই ঘর কিনতে আসছেন। ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী দোচালা, আটচালা, ষোলচালার একতলা, দোতলা, তিনতলা টিনের ঘর বানানো হচ্ছে। সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা থেকে শুরু করে একেকটি ঘর আকার ও নকশা অনুযায়ী ৩৮ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

লৌহজং উপজেলার কলাবাগান এলাকার ফয়েজ টিম্বারে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকেরা কেউ হাতে, কেউ যন্ত্রের সাহায্যে কাঠের মধ্যে নকশার কাজ করছেন। তাঁদের একজন শরীফ মিয়া বলেন, ঘরের চাহিদা বাড়ায় ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। যত্ন নিয়ে নকশাখচিত ঘর বানাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের এখানে সাধারণ ঘর, বারান্দাসহ নকশাখচিত ঘর, বারান্দার ওপর নাকের আকারের টিনের নকশার ঘর পাওয়া যায়। এ ছাড়া ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এক, দুই, তিনতলা ঘরও বানান তাঁরা।

সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা থেকে শুরু করে একেকটি ঘর আকার ও নকশা অনুযায়ী ৩৮ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে
সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা থেকে শুরু করে একেকটি ঘর আকার ও নকশা অনুযায়ী ৩৮ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে

কলাবাগানের জসিম টিম্বারে ঘর কিনতে এসেছিলেন মো. ফেরদৌস। তাঁর বাড়ি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায়। ফেরদৌসের মতে, টিনের ঘরে যে শান্তি, সেটা পাকা দালানে নেই। গরমের সময় ঘরের ভেতর শীতল আর শীতের সময় ঘর থাকে উষ্ণ। দেখতে নান্দনিক, ঘরে বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দ পাওয়া যায়। একেকটি ঘরের স্থায়িত্ব হয় ৫০ থেকে ৮০ বছর।

ফেরদৌস বলেন, ‘আজ যে টাকায় ঘর কিনছি, পাঁচ বছর পর চাইলে সে টাকার চেয়ে বেশি দামে ঘর বিক্রি করা যায়। ঘর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সহজে স্থানান্তর করা যায়। নানাবিধ সুবিধার কারণে আমাদের প্রথম পছন্দ কাঠ-টিনের ঘর। ১৪ লাখ টাকার মধ্যে ২টি ঘর কিনতে এসেছি। ইতিমধ্যে একটি কেনা হয়ে গেছে। আরও একটি কেনার জন্য ঘুরছি।’

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব ঘর নির্মাণের জন্য চট্টগ্রাম থেকে গাছ কিনে আনেন মহাজনেরা। এরপর সেগুলোকে স মিলে কেটে প্রয়োজনীয় আকার দেওয়া হয়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় থেকে আনা হয় টিন। ঘরগুলো জমির ওপর দাঁড় করাতে ব্যবহার করা হয় সিমেন্ট ও লোহার খুঁটি। সেগুলোও ব্যবসায়ীরা নিজেরা তৈরি করেন। এরপর একটি পূর্ণাঙ্গ ঘর প্রস্তুত করতে আরেক দফা কাজ করেন শ্রমিকেরা।

ঘর দেখে অঞ্চল চেনা যায়

এই ‘রেডিমেড’ ঘরগুলো যাঁরা কিনতে চান, তাঁরা ঘর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দুই ধরনের চুক্তি করতে পারেন। বিক্রেতারা তাঁদের নিজস্ব খরচে ঘরগুলো খুলে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে ক্রেতাদের দেখানো জায়গায় বসিয়ে দেন। আবার ক্রেতারা কিনে নেওয়ার পর নিজের খরচেও বসিয়ে নিতে পারেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো প্রয়োজনে সহজেই ঘরগুলোর প্রতিটি জোড়া খুলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যায়। অবস্থাপন্ন ঘরের মানুষ বিশেষ ধরনের টিন দিয়ে বাড়ির ওপর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ করে থাকেন।

ঘর ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, মুন্সিগঞ্জের রেডিমেট ঘরের চাহিদা দেশজুড়ে। মূলত ঘরের নকশা, নান্দনিকতার জন্য ঘরের কদর বেশি। সাধারণ থেকে বিত্তবান ও শৌখিন মানুষেরা প্রতিদিন ঘর কিনতে আসেন। বাড়িতে দালান আছে, এমন ব্যক্তিরাও ঘর কেনেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.