এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুধু ১০ দলেরই খেলা হয়ে থাকবে না, আড়ালে চলবে আরেক অদৃশ্য খেলা। কার উইকেটে কত বেশি রান হবে, কার উইকেটে কত বেশি চার-ছক্কার ঝড়—হবে সেই প্রতিযোগিতাও।
আড়ালের এই প্রতিযোগিতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বকাপের মাঠ প্রস্তুতির দায়িত্বে থাকা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) কিউরেটররা। বিসিসিআইয়ের প্রধান কিউরেটর আশিস ভৌমিক তাঁদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘আমরা ভেন্যুগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা করি, কার ওখানে খেলা সবচেয়ে ভালো হবে, সেই প্রতিযোগিতা। টি-টোয়েন্টিতে এক কিউরেটরের মাঠে ২০০ রান হয়েছে, তো আরেকজনও চাইতে থাকে তার ওখানেও ২০০ রান হোক। একজনের চেয়ে আরেকজনেরটা ভালো হতে হবে।’
২০১৯ সাল থেকে বিসিসিআইয়ের প্রধান কিউরেটর আশিস ভৌমিক। আগামী বিশ্বকাপের ১০ ভেন্যুতে তাঁর নেতৃত্বেই মাঠ ও উইকেট প্রস্তুত করার কাজ করছেন ১৫ কিউরেটর। সবার একটাই উদ্দেশ্য, ‘ভালো’ উইকেট বানানো। আর ‘ভালো’ উইকেট মানে কী, সেটা নিশ্চয়ই আশিসের কথা থেকে এরই মধ্যে ধরে ফেলেছেন। ‘ভালো’ উইকেট মানে রান উৎসবের উইকেট।
আগরতলার মানুষ আশিসের আত্মীয়তা আছে বাংলাদেশের সঙ্গেও। ভারতের চেন্নাই থেকে গত সোমবার ফোনে তিনি বলছিলেন বিশ্বকাপ প্রস্তুতির কথা। তবে সব কথাই আইসিসির আচরণবিধির শৃঙ্খলে থেকে। বিসিসিআই থেকেও মানা করা আছে, উইকেট নিয়ে কোনো কথা নয়। তার মধ্যেই বিসিসিআইয়ের প্রধান কিউরেটরের সঙ্গে আলাপচারিতায় যা বোঝা গেল, সেটি অবশ্য নতুন কোনো আবিষ্কার নয়। অক্টোবর-নভেম্বরে রান উৎসবের বিশ্বকাপই হতে যাচ্ছে ভারতে।
বিশ্বকাপ প্রস্তুতির প্রশ্নে আশিসের মুখে আরেকবার সহকর্মীদের প্রশংসা, ‘আমরা উইকেট বানিয়ে বলে দিতে পারি, কোথায় কত রান করা সম্ভব। কারণ, আমরা আমাদের জন্য টার্গেট ঠিক করি। গত আইপিএলে যে ৩৭ বার ২০০ রান হয়েছে, এমনি এমনি হয়নি। ভারতের কিউরেটররা এখন সে জায়গায় পৌঁছে গেছে।’ তাহলে নিশ্চয়ই এটাও বলে দেওয়া সম্ভব যে বিশ্বকাপের উইকেটে কত রান করে স্বস্তিতে থাকা যাবে!
আশিস এবার একটু রয়েসয়ে বললেন, ‘বিশ্বকাপের উইকেট নিয়ে সেভাবে বলা ঠিক হবে না। তবে ভারতের মাটিতে সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো যদি দেখেন, বিশ্বকাপেও সে রকম উইকেটই হতে পারে। সে রকম রানই করতে হবে। ৩০০-এর বেশি রান হওয়া উচিত প্রতি ম্যাচের দুই ইনিংসেই। বিশ্বকাপের ১০ ভেন্যুতেই এ রকম স্পোর্টিং উইকেট হবে আশা করি।’
বিশ্বকাপের উইকেট সম্পর্কে একটা ধারণা অবশ্য গত ২৯ মে শেষ হওয়া সর্বশেষ আইপিএল থেকেই পাওয়া গেছে। আশিসের চোখে আইপিএলের ১৫টি আসরের মধ্যে এবারেরটাই ছিল সেরা। সেরা কারণ, এবার যে রান হয়েছে বেশি! আশিস হিসাব দিচ্ছিলেন, ‘এবার মোট ৭৪টি ম্যাচের মধ্যে ৩৭ বার ২০০ বা তার বেশি রান হয়েছে। ৮ বার ২০০ বা তার বেশি রান তাড়া করে জিতেছে দলগুলো।’
বিশ্বকাপের জন্যও এ রকম ‘ভালো’ উইকেট বানানোর নির্দেশনা বিসিসিআইয়ের। আর আইসিসি তো বরাবরই চায় সাদা বলের ক্রিকেটে উইকেট হোক রানপ্রসবা। আশিস বলছিলেন, ‘বিসিসিআই খুব গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্বকাপে যেন মাঠ ও পিচের মান খুব ভালো থাকে। ফাস্ট উইকেট হবে, অনেক রান হবে; পেস, বাউন্স, ক্যারি—এগুলো যেন খুব ভালো থাকে। সব মিলিয়ে স্পোর্টিং উইকেট। আউটফিল্ডও বিশ্বমানের করার চেষ্টা করছি। আমাদের চার-পাঁচটা আউটফিল্ড আছে বিশ্বমানের, বাকিগুলোও সে রকম হয়ে যাবে আশা করি।’
ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে যত বেশি রান হবে, ততই দর্শকের আনন্দ। আর দর্শকই যেহেতু ক্রিকেটের প্রাণ, সে প্রাণকে উচ্ছ্বল রাখতে ব্যাটিং উইকেটের বিকল্প দেখেন না আশিস, ‘দর্শকেরা কী দেখতে চায়? ছয়, চার, রান…। ওরা তো লো স্কোরিং ম্যাচ দেখতে আসে না। ৫০ ওভারের ম্যাচে ২০০ রান দেখতে কেউ ভালোবাসবে না।’
বিশ্বকাপ সামনে রেখে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ঘরের মাঠেও ব্যাটিং উইকেট বানিয়ে খেলছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান—দুই সিরিজেই দেখা গেছে সেটা। বিশ্বকাপের জন্য এটাকে ‘একদম আদর্শ’ প্রস্তুতি জানিয়ে আশিস বললেন, ‘বাংলাদেশ তো ওয়ানডে ভালো খেলছে। দলে এক্সাইটিং ব্যাটসম্যান আছে, ওপেনিংয়ে ভালো ব্যাটসম্যান আছে।’
কিউরেটর হিসেবে ভারতে আশিসের সবচেয়ে প্রিয় তাঁর নিজের হাতে গড়া সিকিমের একটা মাঠ। আশিসের ভাষায়, ‘ওখানে গেলে পাগল হয়ে যাবেন। এত সুন্দর!’ তবে আগরতলার মানুষ যেহেতু, তাঁর ‘হোম গ্রাউন্ড’ গুয়াহাটি। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দল দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে আসাম ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের অধীন সেখানকার ড. ভূপেন হাজারিকা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। রান উৎসবের বিশ্বকাপে ঢোকার আগে ম্যাচ প্রস্তুতির জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না বলেই মনে করেন আশিস, ‘ভারতের অন্যতম সেরা উইকেট গুয়াহাটিতে। এখন পর্যন্ত এ মাঠে দুটি ওয়ানডে হয়েছে। দুই ম্যাচের চার ইনিংসেই হয়েছে ৩০০-এর বেশি রান। গত জানুয়ারিতে ভারত সর্বোচ্চ ৩৭৩ করেছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।’
কিন্তু উইকেটের রেসিপিতে যে শুধু ব্যাটসম্যানদের কথা ভেবে রানের মসলাই ছিটানো হচ্ছে, বোলারদের তাহলে কী হবে? বোলারদের জন্য কি তবে দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপই হতে যাচ্ছে এবার? আশিস ‘তা কেন’ বলে উঠে যোগ করলেন, ‘স্পিনারদের জন্য কঠিন হবে, তবে পেস বোলারদের জন্যও কিছু না কিছু থাকবে। যখনই উইকেট গতিময় হবে, বাউন্স থাকবে, উইকেটে পেস বোলারদের জন্যও কিছু থাকবেই। তবে বোলিংটা স্পিননির্ভর হলে চলবে না। এই উইকেটে স্পিনাররা হয়তো রান আটকে রাখতে পারবে, কিন্তু ডিসাইডিং ফ্যাক্টর হবে না।’
আশিস ভৌমিকরা ‘ভালো’ উইকেট বানাচ্ছেন রান উৎসবের আশায়। সেখানে অন্য কিছু ‘ডিসাইডিং ফ্যাক্টর’ হয়ই–বা কী করে!