অস্কার বা একাডেমি অ্যাওয়ার্ডকে বিশ্বচলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। গেল ১২ মার্চ লস অ্যাঞ্জেলেসের হলিউড ডলবি থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হলো অস্কারের ৯৫তম আসর। এবারের আসরে সেরা সিনেমাসহ সর্বাধিক ৭টি বিভাগে অস্কার পেয়েছে ড্যানিয়েল কোয়ান ও ড্যানিয়েল শেইনার্ট পরিচালিত ‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ানস’। চলুন জেনে নিই ছবিটির আদ্যোপান্ত।
‘এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ানস’ ছবির গল্প এগিয়েছে এলভিন ও তাঁর পরিবার ঘিরে। স্বামী, এক কন্যা ও বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে তাঁর সংসার। এলভিনের সাংসারিক জীবনে এই মুহূর্তে রয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। এলভিন লন্ড্রির জন্য ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছেন। ব্যবসা ঠিকমতো না চলায় লোনের কিস্তি দিতে পারছেন না। এমন সময় তাঁর স্বামী ওয়েমন্ড এসেছেন ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে। অন্যদিকে একমাত্র মেয়ে জয় তাঁর গার্লফ্রেন্ডকে এসেছে মায়ের সঙ্গে কথা বলাতে। কিন্তু এলভিন এই বিষয়ে মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে চান না। এমন সময় লন্ড্রির সিসি টিভিতে এলভিন কিছু অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেন। দেখা যায়, তাঁর সহজ-সরল ওয়েমন্ড হঠাৎ অদ্ভুত কিছু আচরণ করছেন; যা তাঁর করার কথা নয়। সেই সময় এলভিনের বাবা লন্ড্রিতে আসেন। নাতনির সঙ্গে অন্য মেয়েকে দেখে জানতে চান কে– এলভিন জানান, জয়ের বন্ধু। ফলে রাগ করে জয় বেরিয়ে যায়।
এরপরই শুরু হয় সিনেমার প্রথম চ্যাপ্টার– এভরিথিং। যেখানে আছেন ওয়েমন্ড, এলভিন ও তাঁর বাবা গংগন। তাঁরা আইআরএস অফিসে যাচ্ছেন। লিফটে ওঠার পর ওয়েমন্ডের চরিত্র বদলে যায়। তিনি ব্লুটুথের মতো কিছু একটা এলভিনের কানে গুঁজে দেন এবং কাগজে কিছু বিষয় লিখে দেন। পাশাপাশি এলভিনের হাতে একটি ডিভাইস দিয়ে দেন; যা সঙ্গে সঙ্গে অ্যাক্টিভিটেট হয়। জানা যায় এলভিনের অতীতের গল্প। তাঁর বেড়ে ওঠা, স্কুলজীবন এবং ওয়েমন্ডের সঙ্গে প্রেম– যা তাঁর বাবা মেনে নেন না। ফলে প্রেমিককে নিয়ে চায়না থেকে আমেরিকা চলে আসেন এলভিন। শুরু করেন লন্ড্রির ব্যবসা।
একসময় তাঁদের কন্যা জয়ের জন্ম হয়। ধীরে ধীরে জয়ের সঙ্গে এলভিনের সম্পর্ক খারাপ হয়। জয় আলাদা হয়ে যায়। পুরো অতীত এলভিন লিফটের মধ্যে দেখতে পান। এলভিন কনফিউজ। তাঁর সঙ্গে এগুলো কী ঘটছে। ওয়েমন্ড কেন তাঁকে এসব বলছেন। ভাবতে ভাবতে এলভিনের দেখা হয় আইএস অফিসারের সঙ্গে। তিনি ব্যবসা নিয়ে নানা কথা বলতে থাকেন। এত কথার মধ্যেও স্বামীর দেওয়া ইন্সট্রাকশন বের করেন। সেখানকার লেখা অনুযায়ী, এলভিন তাঁর দুই পায়ের জুতা অদলবদল করেন। হেডসেটের বাটন চাপা মাত্র এলভিন পৌঁছান একটি ক্লোজের মধ্যে। যেখানে আছেন তাঁর স্বামী ওয়েমন্ড। এখানে একই সময়ে দুটো জায়গায় রয়েছেন এলভিন। প্রথমটি আইএস অফিসে, সেখানে আইএস অফিসার তাঁদের বোঝাচ্ছেন। অন্যদিকে ক্লোজেটর মধ্যে যেখানে তাঁর স্বামী জানান, পৃথিবী এখন ভয়ংকর এক বিপদের মধ্যে। অন্য এক ইউনিভার্স থেকে পৃথিবীতে এসেছে এক শক্তিশালী রিং, যা পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চায়।
বলা ভালো, এই সিনেমার গল্পে রয়েছে সাধারণ মানুষের নানা ইচ্ছার কথা। যেমন আমরা সাধারণ মানুষ জীবনে অনেক কিছু করতে চাই। অনেক কিছুর স্বপ্ন দেখি। অনেক সময় নানা কারণে তা পূরণ হয় না। যদি আমাদের সব স্বপ্ন পূরণ হতো, তাহলে বর্তমানে অন্য এক জীবন হতো। এ কল্পনাই অন্য ইউনিভার্স বলা যেতে পারে। যেমন এই পৃথিবীতে আপনি সাধারণ একজন চাকরিজীবী। কিন্তু অন্য ইউনিভার্সে আপনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করে হয়েছেন বিজ্ঞানী।
যেহেতু এলভিন একই সময়ে দুই ইউনিভার্সে আছেন, তাঁর কাছে ব্যাপারটা কনফিউজিং। ওয়েমন্ড পুরো বিষয়টি বর্ণনা করেন। ওয়েমন্ড অন্য এক ইউনিভার্স থেকে আসছেন। যার নাম আলফাভাট। সেখানকার মানুষ প্রথম আবিষ্কার করেন বিভিন্ন গ্রহের মানুষের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। সেখানকার বড় বিজ্ঞানী ছিলেন এলভিন। তাঁর বানানো জাম্প প্যাড প্রযুক্তির সঙ্গে অন্য ইউনিভার্সের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে। এই জাম্প প্যাড হলো কোনো একটি কোড বা সংকেত, যার মাধ্যমে এলভিন অন্য ইউনিভার্সে নিজের ফর্মকে খুঁজতে থাকেন।
এই সিনেমায় মাল্টিভার্স ভ্রমণ কিন্তু শরীরের হয় না, হয় আত্মার। অন্যদিকে আরেকটি ইউনিভার্সের ভিলেন জুবুটু পাখি। সে আর কেউ নয়। তার মেয়ে জয়। শুরু হয় লড়াই। এরই মধ্য বিভিন্ন ধরনের জাম্প প্যাড ব্যবহার করে বিভিন্ন ইউনিভার্সে নিজের ফর্ম খুঁজতে থাকেন এলভিন। প্রতিটি ইউনিভার্সে এলভিন নিজেকে বিভিন্ন রূপে আবিষ্কার করেন। কখনও সংগীতশিল্পী, কখনও শেফ, কখনও কুংফু মাস্টার। প্রতিটি ইউনিভার্সে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ওয়েমন্ডের। এলভিন বিভিন্ন ইউনিভার্স ঘুরে বুঝতে পারেন তাঁকে কীভাবে কী করতে হবে।
এই ছবি অন্য সায়েন্স ফিকশনধর্মী ছবি থেকে এ কারণেই আলাদা– এই ছবি দেখলে আপনার মনে হবে কোনো হাস্যরসের সিনেমা দেখছেন। অন্যদিকে মনে হয় পারিবারিক গল্পের সিনেমা, আবার মনে হবে রহস্যময় সিনেমা। এই ছবিতে রয়েছে একজন মানুষের হারতে হারতে জিতে যাওয়ার গল্প, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইতিকথা। আছে নিজের জীবনে খুব বেশি স্বাধীনতা দেয়ার ফল। আছে সমস্যা থেকে দূরে সরে নয়, সমস্যার মধ্যেই সমাধান খোঁজার পথ। আছে পরিবারের একাত্মতা। রয়েছে সবাই মিলে থাকলে সুখী হওয়ার কথা। সর্বোপরি রয়েছে, একজন মা আর সন্তানের ভালোবাসার গল্প। সে কারণেই ছবিটি সাতটি শাখায় অস্কার জিতেছে।