কোনো দেশই বিশ্বব্যবস্থার একমাত্র নির্ধারক নয়

0
124

দশ বছর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আমার প্রথম বিদেশ সফর ছিল রাশিয়ায়। গত এক দশকে আরও আটবার দেশটিতে গিয়েছি। প্রতিবারই আমি উচ্চ প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছি এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মিলে চীন-রাশিয়া সম্পর্কের  একেকটি নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেছি।

চীন ও রাশিয়া পরস্পর বৃহত্তম প্রতিবেশী এবং সমন্বিত কৌশলগত অংশীদার। বিশ্ব পরিসরে আমরা উভয়েই বৃহত্তর দেশ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য। উভয় দেশই স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি সমুন্নত রাখি এবং পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ককে কূটনীতিতে অগ্রাধিকার দিই। বৃহত্তর দেশ হিসেবে দায়িত্ব পালনে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়।

জতিসংঘকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এবং জাতিসংঘ সনদের নীতি ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌলিক নিয়মগুলো সুরক্ষার ব্যাপারে আমরা দুই দেশই দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতিসংঘ, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা, ব্রিকস, জি২০সহ অন্যান্য বহুপক্ষীয় পরিসরে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষা করি। একটি বহুমেরু বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৃহত্তর গণতন্ত্রের জন্য একত্রে কাজ করি।

গত ৭০ বা তারও বেশি বছর ধরে চীন-রাশিয়া সম্পর্কের অনন্যসাধারণ যাত্রার দিকে তাকিয়ে আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, খুব সহজেই আজকের অবস্থানে আসা সম্ভব হয়নি। আমাদের বন্ধুত্ব ধারাবাহিকভাবে গভীরতর হচ্ছে এবং এটা সব পক্ষকে প্রতিপালন করে যেতে হবে। বস্তুত চীন ও রাশিয়া রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে মিথস্ক্রিয়ার সঠিক পথটিই খুঁজে পেয়েছে। পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সম্পর্কের পরীক্ষায় পাস করতে হলে ইতিহাস ও বাস্তবতা থেকে জন্ম নেওয়া এই শিক্ষা মনে রাখা জরুরি।

বিশ্ব বর্তমানে এমন গভীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা গত এক শতাব্দীতে দেখা যায়নি। শান্তি, উন্নয়ন ও উইন-উইন সহযোগিতার ঐতিহাসিক এই প্রবণতা অপ্রতিরোধ্য। বহুমেরু বিশ্ব, অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বৃহত্তর গণতান্ত্রিকতার বিদ্যমান এই প্রবণতা অপরিবর্তনীয়। অন্যদিকে বিশ্বকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে জটিল ও পরস্পরবিরোধী প্রথাগত ও অপ্রথাগত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ, ক্ষতিকারক আধিপত্যবাদী কর্মকাণ্ড, চেপে ধরা ও খোঁচাখুঁচি এবং দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া। এই সংকট থেকে বের হওয়ার একটি সহযোগিতামূলক পথ খুঁজে পেতে বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন দেশ হয়রান ও আগ্রহী।

২০১৩ সালের মার্চ মাসে মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসে এক বক্তব্যে আমি বলেছিলাম, বিভিন্ন দেশ এখন পরস্পরের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত ও নির্ভরশীল, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। আর মানব জাতি যেহেতু এখন বাস করছে এক বৈশ্বিক গ্রামে, সেহেতু ক্রমবর্ধমানভাবে এমন এক অভিন্ন ভবিষ্যৎনির্ভর সম্প্রদায়ে পরিণত হচ্ছে, যেখানে প্রত্যেকের স্বার্থ ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল।

পরে বিভিন্ন সময়ে আমি দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, দ্য গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ, দ্য গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ, দ্য গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভ প্রস্তাব করেছি। সবই মানব জাতির অভিন্ন ভবিষ্যৎ সম্প্রদায়ের জন্য আমাদের দর্শন সমৃদ্ধ করেছে এবং তা অর্জনে বাস্তবসম্মত পথ দেখিয়েছে। আমাদের সময়ে বিশ্ব যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা দেখাচ্ছে, এসবই হচ্ছে চীনের দিক থেকে তার প্রতিক্রিয়া।

গত দশ বছরে শান্তি, উন্নয়ন, সমতা, ন্যায্যতা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার মতো মানবতার অভিন্ন মূল্যবোধ জনসাধারণের হৃদয়ে আরও গভীরভাবে গেঁথে গেছে। টেকসই শান্তি, সর্বজনীন নিরাপত্তা ও অভিন্ন সমৃদ্ধি সহযোগে একটি খোলা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুন্দর বিশ্ব ক্রমান্বয়ে আরও বেশি দেশের আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বুঝতে পেরেছে– কোনো দেশই অপর দেশের তুলনায় উচ্চমন্য নয়; কোনো শাসনতান্ত্রিক মডেলই সর্বজনীন নয় এবং কোনো দেশেরই বিশ্বব্যবস্থার একমাত্র নির্ধারক হওয়া উচিত নয়। বিভক্ত ও অস্থিতিশীল নয়; শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ বিশ্বেই মানব জাতির অভিন্ন স্বার্থ নিহিত।

গত বছর থেকে ইউক্রেন সংকটের বহুমাত্রিক অবনতি ঘটেছে। ইস্যুটির গুরুত্ব বিবেচনা করে চীন প্রথম থেকেই একটি নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন অবস্থান গ্রহণ করে এসেছে এবং শান্তি আলোচনায় জোর দিয়েছে। আমি একাধিক প্রস্তাব দিয়েছি যেখানে জাতিসংঘ সনদের নীতি, সব দেশের বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগ, সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শিকলের স্থিতিশীলতার বিষয়গুলো ছিল। ইউক্রেন সংকট সমাধানে এগুলোই চীনের মৌলিক নীতিতে পরিণত হয়েছে।

মাত্র কিছুদিন আগে ইউক্রেন সংকটের রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে চীনের অবস্থান আমরা প্রকাশ করেছি। সেখানে সব পক্ষের বৈধ নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৃহত্তর সাধারণ বোঝাপড়া প্রতিফলিত। মনে রাখতে হবে, একটি জটিল ইস্যুর সরল সমাধান হয় না। আর বিশ্বব্যবস্থা ভালোভাবে পরিচালনা করতে হলে যে কোনো দেশের উচিত প্রথমে ও সবকিছুর আগে নিজের ব্যবস্থা ভালোভাবে পরিচালনা করা। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চীনের জনসাধারণ সেটাই করছে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আধুনিকায়নের চীনা পথ অনুসরণ করে সর্বক্ষেত্রে চীন জাতির নবউদ্যম পর্ব এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

যেমন প্রতিটি নতুন বছর শুরু হয় বসন্তকাল দিয়ে; যে কোনো সাফল্যও শুরু হয় কর্ম দিয়ে। এটা বিশ্বাস করার সব কারণই বিদ্যমান– উন্নয়ন ও উদ্যমের সহযাত্রী হিসেবে চীন ও রাশিয়া মানব জাতির অগ্রগতিতে নতুন ও বৃহত্তর অবদান রেখে চলবে।

শি জিনপিং: চীনের প্রেসিডেন্ট; চায়না পিপলস ডেইলি অনলাইনে প্রকাশিত নিবন্ধের অংশবিশেষ; ভাষান্তর শেখ রোকন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.