সম্প্রতি কীটনাশকের বিষাক্ততায় ঢাকার বসুন্ধরা এলাকার একই পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনা দেশবাসীকে মারাত্মকভাবে ব্যথিত করেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। জিগাতলার জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে এক ব্যক্তি মারা গিয়েছিলেন।
কীটনাশকের বিষাক্ততা সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুব কম। স্বল্প ধারণা নিয়ে না বুঝে কীটনাশকের মতো একটি বিষের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তথ্য মতে, মোবারক হোসেন তুষার ও শারমিন জাহান লিমা দম্পতি বাসায় তেলাপোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য পেস্ট কন্ট্রোল সেবা প্রদানকারী কোম্পানির কাছে থেকে কীটনাশক প্রয়োগ করান। পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি কি ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করেছে তা তারা জানাননি। এই দম্পতির ভাষ্যমতে, কীটনাশক প্রয়োগ করার একদিন পরে বাসায় ঢোকেন তারা। ঘরে ঢোকার পর কিছু সময় তারা স্বাভাবিক ছিলেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরে পরিবারের সদস্যদের পেটে ব্যথা, বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। রোববার ভোরে ওই পরিবারের পাঁচজন সদস্য এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে ভর্তির পর ছোট ছেলে শাহিল মোবারক জায়ান (৯) সকালেই মারা যায়। বড় ছেলে শায়েন মোবারক জাহিন (১৫) মারা যায় বিকেলের দিকে।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশে বাসাবাড়িতে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশকের একটি তালিকা আছে। ইচ্ছে করলেই কোনো কীটনাশক যেখানে-সেখানে ব্যবহার করা যায় না। কীটনাশক ব্যবহারে নীতিমালা ও আইন রয়েছে। কোন ধরনের কীটনাশক জনস্বার্থে ব্যবহার করা যাবে তার একটি তালিকা অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পেস্ট কন্ট্রোল সেবা দানকারী কোম্পানি নিশ্চয়ই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা না মেনে কীটনাশক প্রয়োগ করেছে। এত অল্প সময়ে পরপর দুজনের মৃত্যুর কারণে মনে হচ্ছে, ভালো এবং দ্রুত ফলাফলের জন্য তারা অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড নামক বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করেছে।
অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড একপ্রকার কীটনাশকের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম। এটি এক প্রকার মারাত্মক বিষাক্ত কীটনাশক যা আমাদের দেশে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। ছারপোকা দমনে যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট। বাংলাদেশের বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। এটি বিভিন্ন মানুষের কাছে গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা, ধান ক্ষেতের পোকা, কলা গাছের গুঁর পোকা ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। এই ট্যাবলেট থেকে ফসফিন নামক গ্যাস নির্গত হয়। ঘর বন্ধ অবস্থায় এটি ঘরকে বিষাক্ত করে তেলাপোকা ও ছারপোকা মেরে ফেলে। ফসফিন গ্যাস মানুষের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত।
ফসফাইন গ্যাসের তীব্রতায় শ্বাস-প্রশ্বাসে উচ্চমাত্রার বিষাক্ততা তৈরি করে বলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ করেছে। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট এবং পেলেটগুলো আর্দ্রতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে ফসফাইন গ্যাস নির্গত করে। যার অপব্যবহারে মানুষের জীবনহানি ঘটছে।
অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বাতাসের বিক্রিয়া করে জীবন বিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফাইন তৈরি করে। এটি একটি সাইটোটক্সিক যৌগ যা দেহের গুরুত্বপূর্ণ সেলুলার এনজাইমগুলিকে বাধা দেয় এবং টিস্যুতে সরাসরি ক্ষত সৃষ্টি করে। এর বিষাক্ততায় মৃত্যুর হার ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু না বুঝে না জেনে যারা ছারপোকা মারার জন্য রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে ভেতরে ট্যাবলেট ফেলে চলে যাচ্ছেন এবং কিছু সময় পরে এসে রুম খুলে ফ্যান চালিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা ভাবতেও পারবেন না নিজের কতবড় ক্ষতি করছেন।
কীটনাশকের বিষক্রিয়া মানুষের শরীরে কোষে কোষে পৌঁছে যায়। এটা হচ্ছে মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর, কিডনি লিভার, ব্রেনেও প্রভাব পড়ে, খিচুনি হয়- এরপর তারা মারা যান। ঘরে যেকোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহারের আগে অবশ্যই কোনো অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ লোক দিয়ে কীটনাশক প্রয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রতিটি কীটনাশকের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা এবং ব্যবহারের কিছু নিয়ম আছে। নিয়ম মেনে কীটনাশক ব্যবহার না করলে সেটি ভয়ঙ্কর ফলাফল বয়ে আনতে পারে, যা আমরা বসুন্ধরাতে প্রত্যক্ষ করলাম।
দক্ষ লোক দিয়ে ওষুধ দেওয়া, এর মাত্রা সম্পর্কে জানা, কোন ঔষধ দেওয়া হচ্ছে, কী পরিমাণে দেওয়া হচ্ছে, প্রভাব কতক্ষণ থাকবে এবং এরপর কীভাবে বাড়ি পরিস্কার করা হবে- এসব তথ্য নিশ্চিত হয়ে পরিবারের অন্তত একজন ভালোভাবে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে বুঝে সবাইকে অবগত করা গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এটা একটা‘বিষাক্ত কীটনাশক’এটার ক্ষতিকর দিক থাকবেই। তাই কতটা কম ক্ষতি হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সেফটি ইন্সট্রাকশন শিট গৃহকর্তাকে স্বাক্ষরসহ প্রদান করে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে তার স্বাক্ষর নিয়ে রাখা উচিত। জনসাধারণ, যারা কীটনাশক ব্যবহার করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন তাদেরও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিয়েই ব্যবহার করা উচিত।