কিনতে গিয়ে গরুর বয়স, ওজন, দাম যেভাবে বুঝবেন

0
213
সালমা সুলতানা

সারা বছর বাজার থেকে গরুর মাংস কেনা হয়। শহুরে মানুষের গবাদিপশুর সঙ্গে সরাসরি দেখা হয় বছরের এই একটা সময়ে—পবিত্র ঈদুল আজহায়। গরু কেনা বা রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতাশূন্য মানুষগুলো এই সময়ে পশু কিনতে গিয়ে যেন ‘অগাধ জলে খাবি খান’। কোরবানির পশু, বিশেষত গরু নিয়ে অনভিজ্ঞদের মনে জাগে নানা প্রশ্ন।

হাটে অনেক গরুর ভিড়ে গরুর সঠিক আকার বোঝা মুশকিল। হাটে যেটাকে বড় বলে ভ্রম হয়, কিনে আনার পর দেখা যায় সেটা আসলে অনেক ছোট। বিক্রেতা যেটাকে পাঁচ মণের গরু বলে বিক্রি করেন, পরে দেখা যায় সেটা চার মণও হয় না। দামে ঠকলেন, নাকি জিতলেন, এ নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পড়ে যান এমন শহুরে অনভিজ্ঞ ক্রেতারা। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘গরুটা কি ঠিকঠাক দামে কিনতে পেরেছি, নাকি বেশি দামে ছোট গরু কিনলাম?’

এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বাংলাদেশের শিক্ষা, গবেষণা ও পশু স্বাস্থ্যসেবা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এমএলএএফ) চেয়ারম্যান সালমা সুলতানা। ২০১৫ সালে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাময়িকী এশিয়ান সায়েন্টিস্ট ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল এশিয়ার শীর্ষ বিজ্ঞানীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তার মধ্যে তিন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর একজন ছিলেন সালমা সুলতানা। ২০২২ সালে তিনি অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার পান।

গরুর ওজন কতটুকু, সেটা কীভাবে বোঝা যাবে?

সালমা সুলতানা: গরু-মহিষের ওজন সহজেই দৈর্ঘ্য ও বুকের বেড় পরিমাপের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। তুলাদণ্ডের ব্যবস্থা না থাকলে দৈর্ঘ্য ও বুকের বেড় পরিমাপের মাধ্যমেও গরু–মহিষের ওজন নির্ণয় করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে তুলাদণ্ডের মতো নির্ভুল ওজন পাওয়া যাবে না। এ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ওজন প্রকৃত ওজনের চেয়ে ৫ শতাংশ কমবেশি হতে পারে।
লাইভ ওজন গণনার জন্য এ সূত্রই (শেফারের সূত্র) সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়।

সমীকরণটি হলো W = {L (GXG)} / 660

যেখানে W শরীরের ওজন (কেজি), L হলো প্রাণীর দৈহিক দৈর্ঘ্য = প্রাণীর লেজের ওপরের পিন পয়েন্ট থেকে শোল্ডার পয়েন্ট অথবা পশ্চাদ্দেশের উঁচু হাড় থেকে গলার মাঝবরাবর পর্যন্ত। G হলো বুকের বেড় = সামনের ২ পায়ের ঠিক পেছনের দিক বরাবর বুকের বেড়।
ধরা যাক, একটি গরুর বুকের বেড় ৬০ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য ৪২ ইঞ্চি। তাহলে গরুর ওজন হবে, {৪২ X (৬০ X ৬০)} / ৬৬০ = ৪২ X ৩৬০০) / ৬৬০ = ১৫১২০০ / ৬৬০ = ২২৯ কেজি।

লক্ষ্য রাখতে হবে, মাপের সময় গরুর মাথা যেন সমান্তরাল থাকে। অর্থাৎ খাওয়ার সময় যেমন মাথা নিচু করে থাকে, সে রকম যেন না থাকে। কারণ, গরু যখন মাথা নিচু করে থাকে, তখন এর বুক প্রসারিত হয়। বুকের বেড় মাপতে হবে ঠিক ঘাড় বরাবর। পিঠ বা ঘাড় থেকে তলপেটের মাপ নিলে ভুল ওজন আসবে। ফিতাটি যেন গরুর দেহের সঙ্গে লেগে থাকে। ফিতা বেশি টাইট হলে ওজন কম আসবে আবার বেশি ঢিলা হলে ওজন বেশি আসবে।

 দৈর্ঘ্য ও বুকের বেড় মাপ করে সহজেই গরু-মহিষের ওজন  নির্ণয় করা যায়
দৈর্ঘ্য ও বুকের বেড় মাপ করে সহজেই গরু-মহিষের ওজন নির্ণয় করা যায়

ওজন থেকে দাম বের করা সম্ভব কি?

সালমা সুলতানা: সেটা সম্ভব। গরুর লাইভ ওজনের (সামগ্রিক ওজন) ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ মাংস ধরা হয়। যেমন ২২৯ কেজি ওজনের গরুর ৫০ শতাংশ মাংস ধরলে অর্থাৎ গরুটির ১১৪ কেজির বেশি (২ দশমিক ৮৬ মণ) মাংস এবং বাকিটা হাড়সহ অন্যান্য জিনিসের ওজন। প্রতি কেজি গরুর মাংসের বাজারদরের সঙ্গে গুণ করলে দাম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন ১ কেজি গরুর মাংস যদি ৮০০ টাকা হয়, তাহলে ২২৯ কেজি লাইভ ওজনের গরুর দাম হতে পারে ৮০০ X ১১৪ বা ৯১ হাজার টাকার বেশি। এর পাশাপাশি গরুর রং বা অন্যান্য কিছুর ওপর গরুর মূল্য কমবেশি হতে পারে।

ঢাকার হাটে হাতে হাতে ছোট আকারের গরু

সব বিক্রেতাই দাবি করে ঘরে পালা গরু। গরুটা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পালা হয়েছে, নাকি বিক্রির জন্য অস্বাস্থ্যকরভাবে দ্রুত মোটাতাজা করা হয়েছে, বোঝা যাবে কীভাবে?

সালমা সুলতানা: নিষিদ্ধ ওষুধ বা স্টেরয়েড দিয়ে গরু মোটাতাজা করলে গরুর দেহের চামড়ার নিচে পানি জমে যায়। যকৃৎ ক্ষতি হওয়ার কারণে পানি জমে। সে ক্ষেত্রে এটা সহজেই নির্ণয় করা যায়। গরুর দেহে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে আঙুল সরিয়ে নিলে জায়গাটি যদি দেবে যায় এবং জায়গাটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় নেয়, তাহলে বুঝতে হবে গরুটিকে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে মোটা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মোটা গরুর দেহে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে আঙুল সরিয়ে নিলে জায়গাটিতে দেবে যাওয়ার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না।

গরুটা সুস্থ কি না, কীভাবে বোঝা যাবে?

সালমা সুলতানা: সুস্থ প্রাণীর বাহ্যিক লক্ষণ হচ্ছে প্রাণীটি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি সজাগ থাকবে। নাক, মুখ ও চোখ পরিষ্কার ও উজ্জ্বল থাকবে। শরীরের লোম মসৃণ ও চকচকে থাকবে। নাকের অগ্রভাগে বিন্দু বিন্দু ঘাম থাকবে। দ্রুত মাথা, কান ও লেজ নেড়ে মশা-মাছি তাড়াবে। খাওয়াদাওয়া স্বাভাবিক থাকবে। শরীরের তাপ স্বাভাবিক থাকবে। মলমূত্র স্বাভাবিক এবং এদের রংও স্বাভাবিক থাকবে। প্রাণীটি খাবারের পর স্বাভাবিকভাবে জাবর কাটবে।

রোগের লক্ষ্মণ হচ্ছে, বিষণ্ন ও অবসাদগ্রস্ত থাকবে। মাথা নিচু করে রাখবে। কান ঝোলানো থাকবে। ক্ষুধামান্দ্য থাকবে। চলাফেরা অস্বাভাবিক থাকবে। ডায়রিয়া থাকবে। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেবে এবং নাক দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে থাকবে।

গরুর বয়স বোঝা যায় দাঁত দেখে
গরুর বয়স বোঝা যায় দাঁত দেখে

গরু দেখে সেটা বুড়ো না ছোট, অর্থাৎ বয়স বোঝার কোনো উপায় আছে?

সালমা সুলতানা: অনেক সময় গরু আকারে ছোট হলেও বয়স ঠিক থাকে, আবার কখনো আপাতদৃষ্টে বড় দেখালেও গরুর আসলে কোরবানির বয়সই হয়নি। সেটা বয়স নির্ধারণ করে সহজে বোঝা যায়। গরুর বয়স জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এর দাঁত পর্যবেক্ষণ করা। গরুর দাঁতের সংখ্যা এবং সেই দাঁতের ক্ষয়ের পরিমাণ দেখে নির্ণয় করা যায় তার বয়স। মানুষের যেমন দুধদাঁত বা অস্থায়ী দাঁত রয়েছে, তেমনি গরুরও রয়েছে। গরুর অস্থায়ী দাঁত আকারে ছোট এবং তুলনামূলক বেশি সাদা। জন্ম থেকে এক মাস বয়সের মাঝে অস্থায়ী দাঁত উঠতে শুরু করে। এক বছর বয়সে সামনের মাঝের দুটো অস্থায়ী দাঁত পড়ে যায় ও সেখানে স্থায়ী দুটো দাঁত ওঠে, যেগুলো আকারে পাশের দাঁতগুলোর থেকে বড়। দুই থেকে আড়াই বছর বয়সের মধ্যে গরুর এই দুটো দাঁত বেশ বড় আকার ধারণ করে। তিন বছর থেকে সাড়ে তিন বছর বয়সের মধ্যে গরুর সামনের দুইটা দাঁতের দুই পাশে আরও একটা করে স্থায়ী দাঁত ওঠে, ফলে সামনে স্থায়ী দাঁতের সংখ্যা হয় চারটা।

একটা পূর্ণবয়স্ক গরুর মুখের ভেতর ৩২টা দাঁত থাকে। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে সামনের আটটা স্থায়ী দাঁতই উঠে যায়। পাঁচ বছর বয়সের পর থেকে গরুর দাঁতে ক্ষয়ের চিহ্ন দেখা দিতে শুরু করে।

দাঁত ছাড়া আর কোনো উপায়ে বয়স চেনা যায় কি?

সালমা সুলতানা: শিং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও গরুর বয়স নির্ণয় করা যায়। তবে এটা কম দরকারি। শিংয়ে গোলাকার রিং থাকে। গরুর এক বছর বয়সের মধ্যে প্রথম রিং প্রদর্শিত হয়। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী গরুর শিংয়ে পাঁচটি রিং থাকে। পাঁচ বছর বয়সের পর থেকে গরুর শিংয়ের রিং হালকা হয়ে যেতে থাকে। ৮ বছর বয়সে সব রিং নষ্ট হয়ে যায়।  পর্যবেক্ষণের একটি সূত্র রয়েছে। সেটা হলো, শিংয়ে রিংয়ের সংখ্যা + ২ = গরুর বয়স।

ঈদুল আজহার গরুর হাটে সাধারণত গাভি বিক্রি হয় না। তবে কেউ যদি গ্রামে গিয়ে বা অন্য কারও মাধ্যমে গাভি কিনতে যান, তাহলে গাভিটি গর্ভবতী কি না, সেটা বোঝার উপায় কী?

সালমা সুলতানা: গাভির গর্ভাবস্থা যদি অল্প সময়ের হয়ে থাকে, তবে গাভি সম্পর্কে কম জানাশোনা রয়েছে, এমন ব্যক্তির তা বোঝা সম্ভব নয়। প্রজননকর্মীরা তা বোঝেন। তাঁরা গাভির মলদ্বার দিয়ে হাত প্রবেশ করিয়ে গর্ভাবস্থা বুঝতে পারেন। গাভি কিনতে গেলে প্রজননকর্মীদের নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আরেকটা সহজ উপায় হচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের স্থানীয় কার্যালয়গুলোয় বহনযোগ্য আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র থাকে। সেগুলো নিয়ে খুব সহজেই গাভিটি গর্ভবতী কি না, নির্ণয় করা সম্ভব।

গরুটা ষাঁড় নাকি বলদ, চেনা যাবে কীভাবে?

সালমা সুলতানা: এর জন্য গরুর অণ্ডকোষ দেখতে হবে। অণ্ডকোষে শুক্রাশয়ের উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে গরুটি ষাঁড় না বলদ বোঝা যায়। গরুটির অণ্ডকোষে শুক্রাশয়ের উপস্থিতি থাকলে সেটি ষাঁড়, না থাকলে সেটি বলদ।

গরুর রং (সাদা, কালো, লাল, মিশ্র ইত্যাদি) এবং শিং, কুঁজের আলাদা তাৎপর্য আছে কী?

সালমা সুলতানা: রং, কুঁজ, শিং দেখে গরুর জাত চেনা যায়। তবে এর সঙ্গে গরুর ভালো-মন্দ এবং সুস্থ-অসুস্থতার কোনো সম্পর্ক নেই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সালমা সুলতানা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.