কারাবন্দি চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের ‘দাওয়াত’ জঙ্গিদের

হলি আর্টিসান হামলার ৮ বছর

0
19
২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিসান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা চালানো হয়। ফাইল ছবি

২০১৬ সালের ১ জুলাই; ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় গোটা বিশ্বে তৈরি হয় চাঞ্চল্য। ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে নব্য জেএমবির সদস্যরা। হামলার ৮ বছর পূর্তিতে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দুর্ধর্ষ উগ্রবাদী নব্য জেএমবি এখন পাঁচজনের নেতৃত্বে অনলাইনে সক্রিয়। এ ছাড়া কারাবন্দি চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের টানতে কৌশলে ‘দাওয়াত’ দিচ্ছে তারা।

বর্তমানে নব্য জেএমবির নায়েবে আমির আবু আহসান হাবিব আল বাঙালি ওরফে লায়ন; তিনি সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান ছাড়াও আছেন শূরা বোর্ডে। এ বোর্ডের অন্যরা হলেন রফিক রুহাম, আবু আদনান, আবু উনাইস ও আবু আহসান।

উগ্রপন্থিদের কার্যক্রমে এক যুগের বেশি নজর রাখেন এমন একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন নব্য জেএমবির বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। তাদের লক্ষ্য, সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা সদস্যদের একই প্ল্যাটফর্মে আনা। চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে স্বতন্ত্র সেল করে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া এবং ‘সুবিধাজনক’ সময়ে আবারও হামলার মাধ্যমে আলোচনায় আসা। সংগঠনের কারাবন্দি সদস্যদের মুক্ত করার ছক তৈরি, অনলাইন-অফলাইনে দাওয়াতি কার্যক্রম জোরদার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার মাধ্যমে প্রতিশোধ, উগ্র মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন ভাষার ও আইএস প্রকাশিত আর্টিকেল অনুবাদ করে সদস্যদের মধ্যে সরবরাহের লক্ষ্যও রয়েছে নব্য জেএমবির।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কারাগারে থেকেও কৌশলে নব্য জেএমবির সদস্যরা সক্রিয়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সংগঠনটি ড্রোন আইইডি তৈরির পরিকল্পনা করছে। বিদেশ থেকেও অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছে এক দুর্ধর্ষ জঙ্গি। দাওয়াতি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এসএমএস মার্কেটিং ওয়েবসাইট তৈরির পরিকল্পনা এবং এরই মধ্যে দেড় লাখ মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার এবং বোমা ও অস্ত্র তৈরির দক্ষ কারিগর বানানোর বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েও এগোচ্ছে সংগঠনটি।

আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা নিয়ে নব্য জেএমবি বেশ কিছু বিষয়ে নজর রাখছে। তার মধ্যে রয়েছে প্রবাসীদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায়, কৃষি খামারের আড়ালে ফান্ড সংগ্রহ, সদস্যদের এককালীন ও মাসিক চাঁদা, অটোরিকশা কিনে ভাড়া দেওয়া, বছর দুয়েকের মধ্যে বড় ধরনের ‘হিজরতের’ ঘোষণা।

গোপন কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে সক্রিয় উগ্রপন্থি সংগঠনগুলো নিজ আদর্শে আবদ্ধ নেই। ফলে যে সংগঠন শক্তির জানান দিতে সক্ষম হবে, অন্যরা তার দিকে ঝুঁকবে। বিডিআর বিদ্রোহের মামলা, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ চাঞ্চল্যকর মামলার কারাবন্দিদের সংগঠনে ভেড়াতে দাওয়াতি কার্যক্রম চালানোও নব্য জেএমবি অন্যতম লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। রয়েছে তাবলিগ জামাতের আড়ালে সক্রিয় হওয়ার ছক। নব্য জেএমবির পাশাপাশি আনসার-আল ইসলামও সব জঙ্গি সংগঠনকে এক ছাতার নিচে এনে কার্যক্রম চালাতে চাইছে।

২০২২ সালের ২০ নভেম্বর পুরান ঢাকার আদালত চত্বরে শক্তির জানান দেয় জঙ্গিরা। ঢাকার চিফ জুডিয়িশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চত্বরে পুলিশের কাছ থেকে দুই জঙ্গি– মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান ও আবু সিদ্দিক সোহেলকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। শামীম জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা এবং সোহেল লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন।

ওইদিন মোহাম্মদপুর থানার সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলায় চার্জ গঠনের শুনানির জন্য তাদের আদালতে হাজিরের কথা ছিল। এজলাস থেকে কোর্ট হাজতে নেওয়ার সময় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। এ ছাড়া পাহাড়ে সম্প্রতি জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামের আরেক সংগঠন সক্রিয় হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০ জনের বেশি তরুণকে কথিত হিজরতের মাধ্যমে তারা পাহাড়ে নিয়েছিল।

এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলছেন, হলি আর্টিসানের পর ব্যাপক অভিযানের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও জঙ্গিরা অনলাইনে তৎপরতা অব্যাহত রাখে। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ডি-র‍্যাডিকালাইজেশন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। জামিনে থাকা ও কারাবন্দি জঙ্গিদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। সামাজিকমাধ্যমে সাইবার পেট্রোলিং বৃদ্ধি করা জরুরি।

সূত্র জানায়, গুলশানে হামলার তিন বছরের মাথায় কিছুটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নব্য জেএমবি। ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল গুলিস্তান এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা হয়। একই বছর পুলিশ বক্স টার্গেট করে মালিবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। একই আদলে পল্টন ও খামারবাড়ি মোড়ের পুলিশ বক্স থেকে উদ্ধার করা হয় বোমা। এসব ঘটনায় নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ কামরুল হাসান ওরফে মাহাদী হাসান জন ওরফে আবু আব্বাস আল বাঙালির সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে মাহাদী তুরস্কে গ্রেপ্তার হয়।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ২০২১ সালের পর দেশে আর জঙ্গি হামলা হয়নি। বর্তমানে জঙ্গিদের বড় কোনো হামলা কিংবা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নেই। এখন তারা সাইবার জগতে বেশি সক্রিয়। সদস্য সংগ্রহ, প্রচারণা, প্রশিক্ষণ সব কিছুই সাইবার জগতনির্ভর। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাজাপ্রাপ্ত পলাতক দুই জঙ্গিকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান ডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, জঙ্গিরা এখন কথিত ইসলামী সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আদর্শিকভাবে মিলেমিশে কার্যক্রম পরিচালনা ও সমন্বিত জিহাদি প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছে।

সাহাদাত হোসেন পরশ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.