জাতীয় সংসদে গত বুধবার সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনির বিচার চেয়ে ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের দেওয়া বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বক্তব্যে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজধানীর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ ধ্বংসের অভিযোগ করেন তিনি।
কামাল মজুমদার ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। আদালত এমপিদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভাপতির পদ ছাড়তে বললে কামাল মজুমদার মেয়ে রাশেদা আক্তারকে কমিটির সভাপতি করেন। ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত রাশেদা দায়িত্বে ছিলেন। এরপর কামাল মজুমদার অনুগত সাবেক কাউন্সিলর এ কে এম দেলোয়ার হোসেনকে ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি করেন। গত বছর ২৩ মে পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন। এ পুরোটা সময়ে কামাল মজুমদার প্রতিষ্ঠানটির সর্বেসর্বা ছিলেন।
দেলোয়ারের নেতৃত্বাধীন কমিটির মেয়াদ শেষ হলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ঢাকার জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে নতুন অ্যাডহক কমিটি করলে কর্তৃত্ব হারান কামাল মজুমদার। এর আগে তাঁর অনুগত অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেনকে আদালতের নির্দেশে অপসারণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এসব কারণে দীপু মনির ওপর ক্ষুব্ধ কামাল মজুমদার। সংসদে নাম উল্লেখ না করেই তিনি দীপু মনির বিচার দাবি করেন।
হঠাৎ কেন সংসদে দীপু মনির বিচার চাইলেন– প্রশ্নে গতকাল বৃহস্পতিবার কামাল মজুমদার বলেন, ‘এ নিয়ে এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। পরে এক সময় কথা বলা যাবে, যদি আমার অফিসে আসেন।’
ক্ষমতাসীন দলের এ সদস্যের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে গতকাল কয়েকবার কল দিলেও ধরেননি দীপু মনি।
দীপু মনির সময়ে কী ঘটে মনিপুর স্কুলে
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত কমিটি। ‘তিনি সোয়া দুই বছর ধরে অবৈধভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলেন’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২০ সালের ২ জুলাই বয়স ৬০ বছর হওয়ার পরও তাঁর চাকরির মেয়াদ তিন বছর বাড়ায় গভর্নিং বডি।’ এরপর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তেও ফরহাদ হোসেনের নিয়োগ বিধিসম্মত নয় বলা হয়। এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ায়। পরে আদালতের নির্দেশে গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক মো. জাকির হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিতে নির্দেশ দেয় মাউশি।
তবে পরিচালনা কমিটি এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে গত বছরের ৬ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির মূল বালিকা বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান জাকির হোসেন। তখন দুই পক্ষের রেষারেষিতে প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা তৈরি হয়। জাকির হোসেন পরে দায়িত্ব পান। সেই থেকে কামাল মজুমদারের অপছন্দের লোক প্রধান শিক্ষক।
স্কুলের বিপুল অর্থসম্পদ পাঁচ দশক আগে প্রতিষ্ঠিত মনিপুর স্কুলের ছয়টি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ৩৮ হাজারের বেশি। বছরের শুরুতে টিউশন ফি, ভর্তি ও সেশনচার্জ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির আয় হতো ৩৮ কোটি টাকা। এর বাইরে টিউশন ফি বাবদ প্রতি মাসে ওঠে প্রায় ৪ কোটি টাকা। এই হিসাবে বছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় প্রায় ৮২ কোটি টাকা। এর বাইরে এফডিআর থেকে আসে লভ্যাংশ। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় মাসে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকার মতো। এই হিসাবে বছরে ৫২ কোটি টাকা ব্যয় হলেও ৩০ কোটির বেশি উদ্বৃত্ত থাকে। এই টাকায় উন্নয়নকাজ ও কেনাকাটা চলে এবং তাতে সুবিধা নিতে বিভিন্ন পক্ষ মুখিয়ে থাকে বলে সমকালকে জানান একাধিক শিক্ষক। তাদের ভাষ্য, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। ঝামেলার নেপথ্যে স্কুলের বিপুল এ সম্পদ।
দ্বন্দ্বের বড় কারণ এমপিও এবং ট্রাস্ট
মনিপুর স্কুল ১৯৮৩ সালে এমপিওভুক্ত হয়। ওই সময়ে ৪৫ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হন। পরে এ সংখ্যা বাড়ে। একাধিক শিক্ষক জানান, সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্কুলটিকে দূরে রাখতে একটি পক্ষ শিক্ষকদের চাপ দিয়ে এমপিও প্রত্যাহারের আবেদন করান। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তদন্তেও মিলেছে সে তথ্য। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শিক্ষকদের জোরপূর্বক এমপিও প্রত্যাহারে সই নেওয়া হয়েছে।’
স্কুলটি ট্রাস্টের অধীনে পরিচালনায় সম্মত না হওয়ায় প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন স্থানীয় এমপি কামাল মজুমদারের চক্ষুশূল হন বলে মনে করেন অনেক শিক্ষক। তবে জাকির হোসেন অসুস্থ থাকায় তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, গতকাল মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ অভিভাবক পরিষদের সভাপতি একলিমুর রেজা কোরাইশ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে সংসদে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের অভিযোগে কামাল মজুমদারের বিচার দাবি করা হয়। এতে বলা হয়, ‘মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে কামাল মজুমদার শপথ ভঙ্গ করেছেন। এটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন। এটিকে ট্রাস্ট করার সুযোগ নেই।’