কানাডার হবু প্রধানমন্ত্রী কে এই মার্ক কার্নি, ট্রাম্পকে কি সামলাতে পারবেন তিনি

0
7
কানাডার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি

নতুন প্রধানমন্ত্রী পাচ্ছে কানাডা। দেশটির ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টির প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন মার্ক কার্নি। নিয়ম অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলের প্রধানই কানাডায় সরকারপ্রধান হয়ে থাকেন। সেই হিসাবে, মার্ক কার্নি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মার্ক কার্নি অর্থনীতিবিদ, কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান। তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিতে পারেন।

পেশায় অর্থনীতিবিদ–ব্যাংকার কার্নি এমন এক সময় সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিচ্ছেন, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কানাডার বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বাড়ছে।

সামনেই কানাডার জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। তাঁর আগে সর্বোচ্চ স্তরের জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হলেন ক্ষমতাসীন দলের নতুন প্রধান কার্নি।

দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে হবু প্রধানমন্ত্রীকে। পাশাপাশি সমালোচনা দূর করে, লিবারেল পার্টির বছরের পর বছর ধরে সমর্থন কমে আসার লাগাম টেনে ধরার চ্যালেঞ্জও তাঁর সামনে।

দলীয় ফোরামে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দলের নেতা ও হবু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মার্ক কার্নি বলেন, ‘আমি দিন–রাত একটি লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করব, তা হলো সবার জন্য আরও শক্তিশালী কানাডা গড়ে তোলা।’

দলীয় ফোরামে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দলের নেতা ও হবু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মার্ক কার্নি বলেন, ‘আমি দিন–রাত একটি লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করব, তা হলো সবার জন্য আরও শক্তিশালী কানাডা গড়ে তোলা।’

কানাডায় নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের পর বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। কে এই মার্ক কার্নি? কানাডার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কোন ধরনের নীতি অনুসরণ করার পরিকল্পনা করছেন? তিনি কী আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে তুলনামূলক শক্তিশালী কনজারভেটিভ পার্টির বিরুদ্ধে লিবারেলদের সৌভাগ্য ছিনিয়ে আনতে পারবেন?

অক্সফোর্ডের স্নাতক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকার

কানাডার উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলে মার্ক কার্নির জন্ম। বেড়ে ওঠা দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের আলবার্টা প্রদেশে। তিনি নিজেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘একজন বহিরাগত’ হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি কানাডাকে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার সময়ে নেতৃত্ব দিতে পারবেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডার পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছেন। গত ৪ মার্চ থেকে এটা কার্যকর হয়েছে। ফলে কানাডা বিপর্যয়ের আশঙ্কায় পড়েছে। সামনের দিনগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা জাতীয়তাবাদের অনুভূতি এবং অটোয়াতে স্থিতিশীল নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে নিয়ে এসেছে।

৫৯ বছর বয়সী মার্ক কার্নি ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সময়ে ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর হিসেবে তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন। কানাডাকে আরও গুরুতর মন্দা থেকে রক্ষা করতে দ্রুত ও সিদ্ধান্তমূলক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তাঁকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।

মার্ক কার্নি ঐতিহ্যবাহী হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাকসে এক দশকেরও বেশি সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।

অতিসম্প্রতি মার্ক কার্নি ব্রুকফিল্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবতৃন মোকাবিলার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনিয়োগ সম্প্রসারণ প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।

সংকটের সময় মার্ক কার্নি নিজের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ‘ট্রাম্প ঝড়’ সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন, এমনটাই মনে করছেন তাঁর রাজনৈতিক সমর্থকেরা।

৫৯ বছর বয়সী মার্ক কার্নি ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর হিসেবে তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন। ওই সময় কানাডাকে আরও গুরুতর মন্দা থেকে রক্ষা করতে দ্রুত ও সিদ্ধান্তমূলক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তাঁকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।

মার্ক কার্নি ২০১৩ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে আসেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। ওই বছর যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে আসে, যা ব্রেক্সিট নামে পরিচিত।

যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে ব্রেক্সিটের প্রভাব কমিয়ে আনার জন্য স্বীকৃত ছিলেন মার্ক কার্নি। তবে ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে বলেও মূল্যায়ন করেছিলেন তিনি। এটা ব্রেক্সিটের পক্ষে থাকা যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীলদের ক্ষুব্ধ করেছিল।

মার্ক কার্নির বিষয়ে লেখক, কলাম লেখক ও যুক্তরাজ্যের একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট উইল হাটন বলেন, ‘তিনি (মার্ক কার্নি) একজন সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী গুণসম্পন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার ছিলেন।’

রাজনীতিতে স্বল্প অভিজ্ঞতা

অর্থনৈতিক বিষয়ে মার্ক কার্নির যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বিতর্ক খুব কমই রয়েছে। তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে তাঁর স্বল্প অভিজ্ঞতা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।

এক সময় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন কার্নি। আবাসন সংকট ও জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মোকাবিলায় ট্রুডো সরকারের ব্যর্থতার জেরে ব্যাপক ক্ষোভ নিয়েই পদ ছাড়েন তিনি।

তবে মার্ক কার্নি এর আগে কখনোই এতবড় রাজনৈতিক পদের (সরকারপ্রধান) জন্য লড়াই করেননি। লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের প্রচারে বেশির ভাগ সময় তিনি কানাডার মানুষের কাছে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যয় করেছেন।

কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড্যানিয়েল বেলান্ড বলেন, ‘তিনি (মার্ক কার্নি) এমন একজন মানুষ, যিনি বরাবরই পর্দার আড়ালে ছিলেন।’

প্রচার শুরুর পর বেশকিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মার্ক কার্নি। এর মধ্যে রয়েছে—সরকারি ব্যয়ে লাগাম টানা, আবাসন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, কানাডার ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা, অভিবাসনে সাময়িক রাশ টানা।

জলবায়ু উদ্যোগ ও অর্থায়নবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক একজন বিশেষ দূত বলেন, কার্নি জলবায়ুসংকট মোকাবিলা এবং শুন্য নির্গমনে পৌঁছানোর পথে বেসরকারি খাতকে নেতৃত্বের ভূমিকায় আনাটাকে সমর্থন করেন।

গত মাসে লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে বিতর্কের সময় মার্ক কার্নি বলেছিলেন, ‘কীভাবে সংকট মোকাবিলা করতে হয়, সেটা আমি জানি। আমি জানি কীভাবে শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে হয়।’

কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো
কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোফাইল ছবি: রয়টার্স

পরিপূর্ণ অভ্যন্তরীণ মানুষ

মার্ক কার্নির নিজেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন বহিরাগত হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

লিবারেল পার্টির উপদেষ্টা থাকার সময়, বৈশ্বিক আর্থিক জগতের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে নিজের অভিজ্ঞতার যোগসূত্র তাঁকে ‘সম্পূর্ণ একজন অভ্যন্তরীণ মানুষ (ইনসাইডার) ’ ও ‘একজন পরিপূর্ণ অভিজাত’ করে তুলেছে—কানাডার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক ডেভিড মসক্রপ এই মন্তব্য করেন।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আল–জাজিরাকে আরও বলেন, ‘একই সঙ্গে তিনি (মার্ক কার্নি) একজন দক্ষ নীতি বিশেষজ্ঞ, একজন বিখ্যাত ও সম্মানিত মূলধারার অর্থনৈতিক চিন্তাবিদ।’

পিয়েরে পইলিভর ও তাঁর কনজারভেটিভ পার্টি কয়েক বছর ধরে লিবারেল সরকারের সমালোচনার জন্য ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জনসাধারণের ক্ষোভ ও উদ্বেগের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েছেন। এখনো মার্ক কার্নির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে তাঁরা একই কৌশল প্রয়োগ করছেন।

কানাডার পার্লামেন্টে দুই দশক ধরে লড়াকু বক্তব্য রাখার জন্য পরিচিত রাজনীতিবিদ পিয়েরে পইলিভর। তিনি এই অর্থনীতিবিদ–রাজনীতিককে (মার্ক কার্নি) ঠিক ‘জাস্টিনের মতো’ বলে আক্রমণ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি কার্নিকে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে অজনপ্রিয় নীতিগুলোর সঙ্গে যুক্ত করার কৌশল বেছে নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগে ট্রুডো, রাজা চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ

সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বেগে ট্রুডো, রাজা চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ

ট্রাম্পকে নিয়ে শঙ্কা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বেলান্ড বলেন, কানাডার সাধারণ মানুষ এখন অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে খুব কমই উদ্বিগ্ন। এর চেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কারোপের জেরে কানাডা–যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অনিশ্চয়তা নিয়ে তাঁরা বেশি উদ্বেগে ভুগছেন।

প্রকৃতপক্ষ, ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা গত কয়েক সপ্তাহে লিবারেলদের সমর্থন বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। জনমত জরিপগুলো বলছে, কনজারভেটিভদের সঙ্গে লিবারেল পার্টি জনসমর্থনের ব্যবধান এক সময় ২৬ শতাংশ পয়েন্ট পর্যন্ত ছিল। লিবারেলরা সেটা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছে।

কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যৎ আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। কোন জাতীয় নেতা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সামলাতে বেশি উপযুক্ত—এ প্রশ্নটি নিয়ে কানাডার মানুষ দ্বিধাবিভক্ত।

যদিও প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে মার্ক কার্নিকে এগিয়ে রেখেছে অ্যাঙ্গাস রিড ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটির এক জনমত জরিপে কার্নি ৯ শতাংশীয় পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ট্রাম্পকে সামলাতে উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে মার্ক কার্নির প্রতি আস্থা রেখেছেন ৪৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। আর ৩৪ শতাংশ পইলিভরের পক্ষে আছেন।

আল জাজিরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.