কাঠগড়ায় অধ্যাপক আবুল বারকাতের এক ঘণ্টা

0
20

তখন সকাল ১০টা ১৫ মিনিট। একটি নীল রঙের প্রিজন ভ্যান ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে এসে থামে। ভ্যানের ভেতর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত বের হন। তাঁর দুই হাতে হাতকড়া, মাথায় পুলিশের হেলমেট। দুজন পুলিশ কনস্টেবল দ্রুত তাঁকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যান।

হাজতখানায় ঢোকানোর আগে তাঁর দুই মেয়ে ও কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী তাঁর সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। বেলা ১১টার দিকে আবারও হাজতখানা থেকে আবুল বারকাতকে বের করে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের দোতলায় এজলাস কক্ষে নেওয়া হয়। তখনো বারকাতের দুই হাতে পরানো ছিল হাতকড়া। মাথায় ছিল হেলমেট। তখন অন্য মামলার শুনানি গ্রহণ করছিলেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন। আসামির কাঠগড়ায় থাকা একটি চেয়ারেই বসে ছিলেন আবুল বারকাত।

এই শিক্ষকের দুই মেয়ে তখন আদালতের বারান্দায় পায়চারি করতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবুল বারকাতের মামলার শুনানি শুরু হয়। শেষ হয় দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে। দুদকের পক্ষ থেকে তাঁকে তিন দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়। অপর দিকে বারকাতের পক্ষ থেকে জামিন চেয়ে আবেদন করা হয়।

দুদকের পক্ষ থেকে তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে শুরু করেন পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।

উল্লেখ্য, গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতসহ ২৩ জনের নামে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁদের বিরুদ্ধে এননটেক্স গ্রুপের নামে ২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। পরে ১০ জুলাই গ্রেপ্তার হন আবুল বারকাত। পরদিন তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকার সিএমএম আদালত।

রিমান্ডের পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তি

পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, অধ্যাপক আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর সময়ে পরস্পর যোগসাজশে জালজালিয়াতির মাধ্যমে এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানকে ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক আতিউর রহমান। তিনিও এ মামলার একজন আসামি। আবুল বারকাতের আমলে জনতা ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা ও তাঁর সহযোগী অন্য ব্যক্তিরা বিভিন্ন অনৈতিক কৌশলে এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানকে ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।’

আবুল বারকাত এই জালিয়াতির দায় এড়াতে পারেন না উল্লেখ করে মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, অধ্যাপক আবুল বারকাত ছিলেন জনতা ব্যাংকের অভিভাবক। ওনার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এই ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি এই জালিয়াতির দায় এড়াতে পারেন না। তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়াসহ অন্য সব তথ্য জানা সম্ভব হবে।

অবশ্য দুদকের পিপির বক্তব্যের বিরোধিতা করেন অধ্যাপক আবুল বারকাতের আইনজীবী শাহিনুর রহমান। তিনি আদালতকে বলেন, মাননীয় আদালত, অধ্যাপক আবুল বারকাত একজন বয়স্ক ব্যক্তি। তাঁর বয়স এখন ৭২ বছর। তিনি হৃদ্‌রোগে ভুগছেন, আছে উচ্চ রক্তচাপ। ইতিমধ্যে তিনি দুবার স্ট্রোক করেছেন। এ মামলার ঘটনার সময় ২০১৩ সাল। এক যুগ পরে এসে অধ্যাপক আবুল বারকাতকে মামলার আসামি করা হয়েছে। তিনি একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ। তাঁর একাধিক গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে। দেশি-বিদেশি জার্নালে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতিও ছিলেন।

অধ্যাপক আবুল বারকাতকে বিকেলে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়ার সময় ছবিটি তোলা
অধ্যাপক আবুল বারকাতকে বিকেলে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়ার সময় ছবিটি তোলা

আইনজীবী শাহিনুর রহমান আরও বলেন, ‘দুদকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২৯৭ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে আমার মক্কেল যুক্ত। অথচ ব্যাংকিং রীতিনীতি, আইন ও বিধি মেনেই ঋণ দিয়েছিল জনতা ব্যাংক। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর রিপোর্ট (সিআইবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন হওয়ার পর জনতা ব্যাংক সেই ঋণ মঞ্জুর করেছিল।’

আবুল বারকাতের আইনজীবীর এই বক্তব্যের পর দুদকের পিপি মাহমুদ হোসেন আদালতকে বলেন, ‘জনগণের টাকা গচ্ছিত থাকে ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরও এই আর্থিক জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে জড়িত।’

আদালত তখন বলেন, বিদেশে অর্থ পাচার হয়েছে। এর জন্য অনেকেই দায়ী। অনেক আর্থিক লোপাট হয়েছে। একসময় জনতা ব্যাংকের সুনাম ছিল। কিন্তু আর্থিক অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। আদালত যখন কথা বলছিলেন, তখন আবুল বারকাত কাঠগড়ায় নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন।

দুর্নীতির মামলায় শাস্তি কম উল্লেখ করে আদালত আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, এত বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা, এত আর্থিক দুর্নীতি, এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা দুদকের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার। দুর্নীতির মামলায় শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন আদালত। একই সঙ্গে তিনি ট্রুথ কমিশন গঠনের যৌক্তিকতার কথা তুলে ধরেন। বিচারক বলেন, যাঁরা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছেন, তাঁদের সেসব অর্থ ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমার ব্যবস্থা করা উচিত।

উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে পরে আদালত জামিনের আবেদন নাকচ করেন। পাশাপাশি রিমান্ড আবেদনের শুনানি সিএমএম আদালত গ্রহণ করবেন বলে জানান।

এরপর আবুল বারকাতকে এজলাস কক্ষ থেকে বের করে আবার হাজতখানায় আনা হয়। এ সময়ও তাঁর দুই হাতে পরানো ছিল হাতকড়া। পরে তাঁকে বেলা দুইটার পর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানা থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানায় নেওয়া হয়। তখন তাঁর মাথায় হেলমেট ও হাতে হাতকড়া ছিল না। সেখান থেকে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁকে ঢাকার সিএমএম আদালতের চারতলায় একটি এজলাস কক্ষে নেওয়া হয়। রাখা হয় আসামির কাঠগড়ায়। তখন অধ্যাপক আবুল বারকাতকে ভীষণ বিমর্ষ দেখা যায়। কাঠগড়ায় তাঁর কাছে আসেন দুই মেয়ে। আবুল বারকাত তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এ সময় মেয়েরা কাঁদতে থাকেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তাঁরা আদালতের এজলাস কক্ষের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে এজলাসে আসেন ঢাকা মহানগরের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) মো. জাকির হোসেন। পরে আবুল বারকাতের রিমান্ড শুনানি শুরু হয়। দুদকের পক্ষ থেকে পিপি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্য শেষ হলে আবুল বারকাতের আইনজীবী শাহিনুর রহমানও রিমান্ডে না নেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এ সময় আবুল বারকাত নিজে আদালতে কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, যে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি কোনোভাবে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। ব্যাংকিং নিয়মকানুন ও রীতিরীতি মেনেই এই ঋণ দেওয়া হয়েছিল।

উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত অধ্যাপক আবুল বারকাতের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ঘড়ির কাটায় তখন সোয়া চারটা। পরে তাঁকে এজলাস কক্ষ থেকে পুলিশি প্রহরায় সিএমএম আদালতের হাজতখানায় নেওয়া হয়।

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.