কাঁধে রামদা নিয়ে মহড়া দিচ্ছে একদল কিশোর। বাজারের বিভিন্ন সড়কে মহড়ায় চারদিক থমথমে। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার উচাখিলা ইউনিয়নে গত ২২ মে চালানো এ মহড়ার চিত্র সিসিটিভি ক্যামেরায়ও ধরা পড়ে। এই ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তৎপর হয় পুলিশ। কিশোর গ্যাংয়ের পাঁচ সদস্যকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে শনিবার আদালতে সোপর্দ করেছে।
উচাখিলা ইউনিয়নে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়েছে বেশ কিছুদিন আগে। দুটি গ্রুপ শক্তি প্রদর্শন করতে মহড়া দেয়। অস্ত্র হাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিও শেয়ার করে তারা। একটি গ্রুপের কিশোররা কাঁধে অস্ত্র নিয়ে উচাখিলা বাজার এলাকায় প্রতিপক্ষের কিশোরদের খুঁজছিল।
পুলিশ জানায়, দুটি গ্রুপের মধ্যে একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় চরআলগী গ্রামের আশিক মিয়া। সে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুর হাসান খান সেলিমের লোক হিসেবে পরিচিত। অপর গ্রুপে নেতৃত্ব দিচ্ছে উজানচর নওপাড়া গ্রামের আনন্দ মিয়া। এই গ্রুপটি রাজীবপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান একেএম মুদাব্বিরুল ইসলামের সমর্থন পাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
আধিপত্য বিস্তারের জন্য এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের সদস্যদের মারধর করত ও হুমকি দিয়ে আসছিল। নিজের ফেসবুকে আশিক একাধিক অস্ত্র হাতে ছবি শেয়ার করে। আনন্দ গ্রুপ গত ২২ মে উচাখিলা বাজার এলাকায় রামদা হাতে মহড়া দেয়। এর পর আনন্দ গ্রুপের ফেরদৌস মিয়া ১ জুন পথরোধ করে আশিক গ্রুপের রিয়াদ মিয়ার। ফেরদৌস এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং রিয়াদ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র। ফেরদৌস পথরোধ করে রিয়াদের কাছে সিগারেট চায়। সিগারেট না দেওয়ায় মারধর করে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয় বলে জানায় পুলিশের হাতে আটক ফেরদৌস।
এ নিয়ে শুক্রবার রাতে ঈশ্বরগঞ্জ থানায় মামলা করে রিয়াদ। কিশোর গ্যাংয়ের ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০ জনকে আসামি করে মামলা হয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে আনন্দ গ্রুপের ৫ সদস্যকে দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। তারা হলো– উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আনন্দ মিয়া, দ্বিতীয় বর্ষের ফেরদৌস, রফিয়ার আলগী গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র আমিনুল ইসলাম ছোট্ট, উজানচরনওপাড়া গ্রামের দশম শ্রেণির নাঈম হাসান, আলাদিয়ার আলগী গ্রামের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আলমগীর কবীর। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনসেট, চাকু, ছুরি, দা এবং লোহার রড জব্দ করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, আনন্দ মিয়া, আমিনুল ইসলাম ও নাঈম হাসানের বিরুদ্ধে এর আগে ২০২২ সালে মারামারির ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। অন্য গ্রুপের সদস্যরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।
পুলিশ হেফাজতে থাকা আনন্দ মিয়া জানায়, চরআলগী গ্রামের আশিকের নেতৃত্বে গ্রুপটি গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর থেকে অত্যচার শুরু করে। উজানচরের মানুষ উচাখিলা বাজারে এসে মাথা উঁচিয়ে কথা বলতে পারবে না বলে ঘোষণা দেয়। প্রায়ই এলাকার ছেলেদের অকারণে মারধর করায় বাধ্য হয়ে অস্ত্র নিয়ে তারা মহড়া দিয়েছে। সে আরও জানায়, আশিক, নিরব, লিকসন, মাহমুদুল, সাগর, মনিরের নেতৃত্বে গ্রুপ বারবার অত্যাচার করলে তারা কয়েকজন সংঘবদ্ধ হয়ে টিকে থাকার জন্য এসব করেছে।
উজানচর নওপাড়া গ্রামের নাঈমের বাবা লিটন মিয়া বলেন, ‘দুই ইউনিয়নের দুই চেয়ারম্যান এসব করাচ্ছেন। ছেলেরা তাঁদের পালিত।’ উচাখিলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবদুল হালিম বলেন, ‘গ্যাংয়ে জড়িয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে আচরণ করায় সম্প্রতি নবম শ্রেণির জিলানীকে বহিষ্কার করা হয়। সমাজে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরাই গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিচ্ছেন। গত বছর থেকে এই প্রবণতা দেখা দিয়েছে। মোবাইল ফোনের অযাচিত ব্যবহারে এসব বাড়ছে। অভিভাবক ও সমাজের সব পক্ষ সচেতন না হলে এসব রোধ করা যাবে না।’
উচাখিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম বলেন, কয়েক গ্রামের উঠতি বয়সী ছেলেরা গ্রুপে বিভক্ত। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সঙ্গে শুধু শুধু বিশৃঙ্খলায় জড়ায়। তাদের শাসন করা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
কিশোর গ্যাং সদস্যদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘মানুষ ধারণা করে, আমি চেষ্টা করলেই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি সম্ভব না।’ রাজীবপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুদাব্বিরুল ইসলামের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসি পিএসএম মোস্তাছিনুর রহমান বলেন, ‘বিপথগামী কিশোরদের ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে অভিভাবকদের নিয়ে সচেতন করা হয়। কিন্তু কাজ না হওয়ায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’