কাঁদতে কাঁদতে অচেতন হয়ে পড়ছেন দীপ্তর মা

টরন্টোয় ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

0
142
বাবা, মা ও বোনের সঙ্গে আরিয়ান আলম দীপ্ত (সবার বামে)। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া

‘তোমরা সবাই আছো, শুধু আমার কলিজার টুকরা ভাইটা নেই। তোমরা ওকে কেন বিদেশে যেতে দিলে? ওকে আটকালে তো আর এমন কিছু ঘটত না। ও নাকি আর কোনোদিন বাড়িতে ফিরবে না। আমি আর কোনোদিন ওকে দেখতে পাব না। এটা আমি মানতে পারব না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলছিলেন কানাডার টরন্টোয় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বাংলাদেশী শিক্ষার্থী আরিয়ান আলম দীপ্তর (২১) বোন অনন্যা আহসান দোলা।

রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ার ২৩ নম্বর ভবন ‘জুবিলেশন’র ষষ্ঠ তলায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন দীপ্ত। গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি উচ্চতর পড়ালেখার উদ্দেশে টরন্টোয় যান। সেখানকার নামি প্রতিষ্ঠান হামবার্গ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে ভর্তিও হয়েছিলেন। এক মাস আগে তাঁর ক্লাস শুরু হয়। এর মধ্যে ১১ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন। সেই উপলক্ষে তিন বন্ধু কেক ও ফুল নিয়ে তাঁর ভাড়া বাসায় যান। জন্মদিন পালনের একদিন পর স্থানীয় সময় সোমবার রাতে তারা গাড়ি নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছিলেন। এই বেড়ানোই যে কাল হবে কে জানত!

কানাডার পুলিশ ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ১৪০ কিলোমিটার গতিতে চলা গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এতে প্রাণ হারান দীপ্তসহ তিন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী। তাঁদের আরেক বন্ধু বাংলাদেশের খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের ছেলে নিবিড় কুমার সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

আজ বুধবার দীপ্তদের নাখালপাড়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বেদনাবিধুর দৃশ্য। কাঁদতে কাঁদতে বারবার অচেতন হয়ে পড়ছেন তাঁর মা রেজিনা সুলতানা। উদ্ভ্রান্তের মতো একবার এ ঘরে আরেকবার অন্য ঘরে ছুটছেন ভাই-বোনেরা। আর একটু পর পর বলছেন, ‘দীপ্ত কোথায়? কোন ঘরে দীপ্ত? ওর কিচ্ছু হতে পারে না।’ তখন তাঁদের বাবা আবাসন ব্যবসায়ী এটিএম আলমগীর নামাজ পড়ে ছেলের জন্য দোয়া করছিলেন। তাঁর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।

কানাডায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আরিয়ান আলম দীপ্তর ঢাকার বাসায় বাবা-মায়ের কান্না। ছবি: মাহবুব হোসেন নবীন

এটিএম আলমগীর বলেন, ‘নিয়মিতই ফোনে কথা হত। শেষবার কথা হয় ওর জন্মদিনে। শুভেচ্ছা জানালাম। খাওয়া-দাওয়া করেছে কি না জানতে চাইলাম। সেদিন ক্লাস করেছে বলেও জানাল। তবে বেশিক্ষণ কথা বলিনি। হায়রে সোনা! তখন কি আর জানতাম এটাই শেষ কথা।’

তিনি জানান, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে মেয়ে সানজিদা আলম মাইশা প্রথমে তাঁকে দীপ্তর দুর্ঘটনার খবর জানান। খোঁজ নেওয়ার একপর্যায়ে রাত ৩টা নাগাদ তিনি ছেলের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হন। চার ভাই-বোনের মধ্যে দীপ্ত ছিলেন সবার ছোট।

হতভাগ্য এই বাবা জানান, দেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাস্টারমাইন্ড ও অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনালে পড়ালেখা করেন দীপ্ত। তাঁর স্বপ্ন ছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার। কয়েক বন্ধু কানাডায় যাওয়ার পর তিনিও সেখানকার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চান। পরিবার তাতে সম্মতি দেয়। সেখানে গিয়ে তিনি গত ডিসেম্বর পর্যন্ত নর্থ ইয়র্কে বন্ধু নিবিড় কুমারের বাসায় ছিলেন। এরপর নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে ইতোবিকো এলাকার বাসায় ওঠেন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে তাঁর তিন বন্ধু নিবিড় কুমার, শাহরিয়ার খান মাহির ও অ্যাঞ্জেলা বাড়ৈ ওই বাসায় যান। তারা একসঙ্গে অনেক আনন্দ করেন। এরপর বন্ধুরা তাঁকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। তারা চারজনই বের হন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন নিবিড়। একটি সাবওয়ে থেকে হাইওয়েতে ওঠার সময় অতিরিক্ত গতির কারণে গাড়িটি সড়কের পাশের কংক্রিটের দেওয়ালে ধাক্কা লাগে। এতে গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। সেইসঙ্গে আগুন ধরে যায়।

দীপ্তর বাবা বলেন, ‘শৈশবেই গাড়ি চালানো শেখে দীপ্ত। খুব ভালো গাড়ি চালাতে পারত। অথচ সেই গাড়ি দুর্ঘটনাতেই ওর প্রাণ গেল।’

স্বজনরা জানান, দীপ্ত গত এক বছরে দু’বার দেশে এসে মাসখানেক ছিলেন। শেষবার আসেন গত ঈদুল ফিতরে। এরপর ২৫ জুন বড় বোন তানজিনা আলম সিনথিয়ার সঙ্গে প্রথমে দুবাই যান। সেখান থেকে দীপ্ত যান টরন্টোয়। আর তানজিনা ফ্লোরিডায়। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তাঁর বোন-ভগ্নিপতি টরন্টোয় মরদেহ আনতে গেছেন।

দীপ্তর বন্ধু তাহসিন আহমেদ হৃদয় বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমরা বন্ধু। একসঙ্গে পড়তাম, খেলতাম। খুবই নম্র-ভদ্র আর লাজুক স্বভাবের ছেলে ছিল। সবসময় বন্ধুদের নিয়ে আনন্দে মেতে থাকার চেষ্টা করত। সেই দীপ্ত যে এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে- বিশ্বাসই করতে পারছি না।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.