দেশের উপকূলীয় নদ-নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে—৩৯ শতাংশ। এরপর রূপসা নদীতে—প্রায় ৩২ শতাংশ।
দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। কর্ণফুলী নদীর দূষণ ও প্রতিকার নিয়ে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক প্রণব বলের সঙ্গে কথা বলেছেন নদী গবেষক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী। তাঁর গবেষণার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কর্ণফুলী নদী। সাক্ষাৎকারে এসেছে রূপসা নদীর কথাও।
প্রথম আলো: কর্ণফুলী নদীর দখল-দূষণের অবস্থা কেমন?
ইদ্রিস আলী: এই নদী মরণপণ যুদ্ধ করছে। নদী দখলের বিরুদ্ধে আদালত রায় দিয়েছেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক অপেশাদারত্ব ও রাজনৈতিক নির্লিপ্ততায় দখলদার উচ্ছেদ সম্পন্ন করা যায়নি। ড্রেজিংয়ের নামে নদীটিকে সংকুচিত করা হয়েছে। নদীটির গড় গভীরতা ২০ শতাংশ কমেছে। নদীটিতে পানি ধারণক্ষমতা কমেছে। নদীর গড় প্রস্থ কমে এসেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর ৭৫ লাখ নগরবাসীর পয়োবর্জ্য যাচ্ছে এ নদীতে। কঠিন বর্জ্য, তরল বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্যের সিংহভাগ নগর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্বক্ষণিক নির্লিপ্ততায়, আইন প্রয়োগকারীদের অন্যমনস্কতায় এই নদীকে গ্রহণ করতে হচ্ছে। ফলে নদীটি তার বাস্তুতান্ত্রিক ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়েছে। পানির গুণগত মান অবনমন হয়েছে। হারিয়ে গেছে অনেক প্রজাতির মাছ। রাসায়নিক দূষণও কম নয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৭টি শিল্প জোনের বর্জ্যেরও শেষ আশ্রয়স্থল এই নদী।
প্রথম আলো: সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক গবেষণায় কর্ণফুলী নদীতে সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩৯ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণ হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
ইদ্রিস আলী: এটার সত্যতা নিকট অতীতে দেখা গেছে। ছয় ফুট ড্রেজিং করতে গিয়ে শুধু পলিথিনের স্তরের কারণে ড্রেজার থেমে গেছে। পলিথিনের বিশাল সাম্রাজ্য আবিষ্কৃত হয়েছে তলদেশে। অপচনশীল, দীর্ঘ মেয়াদে মাটিতে অবস্থান করা, শেষে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হওয়া, মাছ কিংবা জলের বাস্তুতন্ত্রে এই দূষণের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। নদী ব্যবহারকারীরা, বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা এই নদীর দূষণকে ত্বরান্বিত করছে। সিটি করপোরেশন, বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা কোনোভাবেই এ বিপর্যয়ের দায় এড়াতে পারে না।
প্রথম আলো: দূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়?
ইদ্রিস আলী: কর্ণফুলী নদীর দূষণ এড়াতে উল্লিখিত সংস্থাগুলোকে সমন্বয়ের সঙ্গে নদীর স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নদীর অনুষঙ্গগুলোকে সুরক্ষিত ও সুবিন্যস্ত রাখতে হবে। নদী রক্ষায় বিদ্যমান আইনের কার্যকারিতা দৃশ্যমান করতে হবে। নদী রক্ষা কমিশনকে আরও গতিশীল এবং কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পলিথিনের মতো ক্ষতিকর পরিবেশ বৈপরীত্য পদার্থের ব্যবহারে বিধিবিধান প্রয়োগে নির্লিপ্ততা পরিহার করতে হবে।
প্লাস্টিক বর্জ্যে শীর্ষে কর্ণফুলী ও রূপসা
প্রথম আলো: প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণের জন্য করণীয় কী?
ইদ্রিস আলী: পলিথিন-প্লাস্টিক ব্যবহারের বিকল্প তৈরি করতে হবে। অপচনশীল ক্ষতিকর সব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভাগাড় হিসেবে খাল কিংবা নালাকে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে সরাসরি কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ছে এসব প্লাস্টিক ও পলিথিন। যদি পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে তা রিসাইক্লিংয়ে নজর দেওয়া জরুরি। এ জন্য ব্যবহারকারীদের উৎসাহ দিতে হবে। এ ছাড়া প্লাস্টিক দূষণের জন্য তাৎক্ষণিক জরিমানাসহ নানা বিধান প্রয়োগ করা যায়।
প্রথম আলো: জাতীয় অর্থনীতিতে কর্ণফুলী নদীটির গুরুত্ব ও অবদান কেমন?
ইদ্রিস আলী: এই নদীর ওপর ভিত্তি করে আমাদের সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠেছে। আমাদের বহির্বাণিজ্যের ৯৩ শতাংশের অংশীজন এই নদী। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও নানাভাবে অবদান রাখছে কর্ণফুলী। দেশের বাণিজ্যিক প্রক্রিয়াকে বিশেষভাবে স্বাধীনতার পর থেকে বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে এই নদীর অবদান কোনোভাবেই ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি এই নদী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের নদী। শিল্প-সাহিত্য, আঞ্চলিক লোকগাথা ও লোকসংস্কৃতি রচিত হয়েছে এই নদীকে ঘিরে। নির্মীয়মাণ মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানা শিল্পোদ্যোগের মূলে এই সমুদ্রবন্দর। তাই বলা যায়, সমৃদ্ধির সূচক কর্ণফুলী।
প্রথম আলো: কর্ণফুলীর পরেই বেশি দূষণের শিকার রূপসা। এই নদীর দূষণ নিয়ে কিছু বলবেন?
ইদ্রিস আলী: রূপসাও জোয়ার-ভাটার নদী। রূপসার দূষণ কর্ণফুলীর তুলনায় কম হওয়ার কারণ খুলনায় চট্টগ্রামের চেয়ে মানুষ কম। কিন্তু মানুষের স্বভাব এক। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার সেখানেও রয়েছে। তাই গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করার দায়িত্ব নদী কমিশনকে নিতে হবে। আর সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে মানুষের স্বভাবে পরিবর্তন আনতে হবে।