কমলা-ট্রাম্প লড়াই: লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহরে যে চিত্র দেখা গেল

0
39
যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের লেক চার্লস শহরে ঘূর্ণিঝড় লরার আঘাতে লন্ডভন্ড বাড়িঘর, ফাইল ছবি: এএফপি
উপকূলরেখার কয়েক শ গজ দূরে—যেখানে দক্ষিণ-পশ্চিম লুইজিয়ানার ছোট্ট শহর ক্যামেরনের সঙ্গে মিলেছে মেক্সিকো উপসাগর; সেখানে চার বছরের পুরোনো ধ্বংসস্তূপের জঞ্জাল মাড়িয়ে যাচ্ছে আমার পা।
 
একটি ব্যাপটিস্ট গির্জার লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া বেঞ্চগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। গির্জার মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকগুলো কাচ আর কাঠের টুকরো। গির্জাটির ছাদের একটি পাশ ধসে গেছে। সেদিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
 
২০২০ সালে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে তছনছ হয়ে যায় ক্যামেরনের জনজীবন। সেখানকার বেশির ভাগ এলাকা তারই ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। লম্বা সময় ধরে এখানকার বাসিন্দারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যন্ত এলাকাটিকে ‘পৃথিবীর শেষ প্রান্তের’র সঙ্গে তুলনা করে আসছেন। তবে এ কথাটি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি সত্য বলেই মনে হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়গুলোর পর এখানকার জনসংখ্যা দুই হাজার থেকে কমে কয়েক শ জনে নেমেছে; একের পর এক জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া বাড়িগুলোর ভেতরে ভিটের চিহ্ন রয়েছে। দিগন্তে উঁকি দিচ্ছে দানবাকৃতির একটি গ্যাস রপ্তানি টার্মিনাল।
 
রাস্তার ধারে দেখা হলো লারলিন রড্রিগের সঙ্গে। তিনি আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এসেছেন। আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পারিবারিক বাড়িটির পাশেই একটি ভ্রাম্যমাণ নিবাসে (ট্রেইলার) বসবাস করছেন এই নারী। কারণ, এখনো তাঁদের বাড়িটির মেরামত শেষ হয়নি। পাশেই একটি কবরস্থানের দিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, হারিকেন লরায় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস তাঁর মৃত বাবার কফিনটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কয়েক বছর ধরে সেটি নিখোঁজ ছিল। কয়েক মাস আগে কফিনটি খুঁজে পাওয়া গেছে। অবশেষে সেটি দাফন করা হয়েছে।
 
হারিকেন লরার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লারলিন রড্রিগে বলেন, ‘আমরা ফিরে এসেছি। কিন্তু আবার যদি এমন ঘূর্ণিঝড় হয়, আমি আর ফিরব না। যথেষ্ট হয়েছে।’
 
লুইজিয়ানার এই অঞ্চলের আর্দ্র জলাভূমি আর উপকূলের জনবসতিগুলো আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে না। তবে নির্বাচনের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ এলাকার তুলনায় এসব জনগোষ্ঠীর ওপর বেশ ভালো প্রভাব রাখবে। কারণ, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ; জ্বালানি তেল ও গ্যাসশিল্পের কারণে ক্রমবর্ধমান দূষণ; আর আশঙ্কাজনকভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে এসব মানুষ। যদিও ভোটের দিন ঘনিয়ে এলেও তাঁদের নিয়ে খুব একটা আলাপ-আলোচনা নেই বললেই চলে। এ অঞ্চলে কয়েক দশকের বেশি সময় ধরে ডেমোক্রেটিক পার্টির উপস্থিতি নেই। তাই এবারও সেখানে ট্রাম্পের জেতার সম্ভাবনাই বেশি।
 
২০১৬ সালে ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় এলাকার অভিজাতেরা এ অঞ্চল কী ঘটেছিল তা নিয়ে লিখতে শুরু করেন। ‘স্ট্রেঞ্জারস ইন দেয়ার ওন ল্যান্ড’ নামের একটি বইয়ে সমাজবিজ্ঞানী আরলি রাসেল হকশিল্ড লুইজিয়ানার ওই অঞ্চলে ‘টি পার্টি’ আন্দোলন কীভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তার সুলুক সন্ধান করেন। এর সূত্র ধরে ‘দ্য গ্রেট প্যারাডক্স’ (মহা হেঁয়ালি) আলোচনায় আসে। হকশিল্ডের বলছে, লুইজিয়ানার জলবায়ু সংকটে বিপর্যস্ত বাসিন্দাদের মতো যে ভোটারদের কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা ও আইনের সমর্থন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাঁরা কীভাবে রিপাবলিকান পার্টিকে ভোট দেন—যে দল কিনা এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। মহাহেঁয়ালি বললেই কেবল সেটা বোঝা যায়।
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস (বাঁয়ে) ও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস (বাঁয়ে) ও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: এপি
 
লারলিন রড্রিগে বলেন, তিনি জলবায়ুবিজ্ঞানের বিষয়টি মানেন (ট্রাম্পের ভাষায় যা ভুয়া), আর বেশি বেশি গ্যাস টার্মিনাল নির্মাণের কারণে সৃষ্ট দূষণ এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবের বিরোধী তিনি (আগামী মাসে ট্রাম্প জিতলে নিশ্চিতভাবে এটিই ঘটবে)। এরপরও তিনি ট্রাম্পকেই ভোট দেবেন। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি চীন থেকে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য আমদানিতে ট্রাম্পের শুল্কারোপের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, এখানে চিংড়ি চাষ করে জীবন যাপন করা মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। তাঁদের সংরক্ষণের জন্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ সিদ্ধান্ত ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। লারলিন রড্রিগে ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ পেশার সঙ্গে জড়িত।
 
ক্যামেরনের আরও ভেতরে ধনীদের একটি ক্লাবে রিপাবলিকান উইমেন অব সাউথওয়েস্ট লুইজিয়ানা নামের সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ক্লাবটি একটি হ্রদের ধারে অবস্থিত। হ্রদটি রাসায়নিক কারখানা দিয়ে ঘেরা। সেগুলো নিয়তই আকাশে দূষিত শ্বাস ফেলছে। হকশিল্ডও এই সংগঠনটির সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি তাঁর ‘গ্রেট প্যারাডক্স’ ধারণার বিস্তারিত ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন। এর মধ্য রয়েছে জনমিতি (ডেমোগ্রাফিক) পরিবর্তন, একটি ভারসাম্যহীন অর্থনীতি, ধর্মীয় কঠোরতা ও বর্ণভিত্তিক অসন্তোষ। এগুলোর বেশির ভাগই এখন সেখানে বিদ্যমান এবং সম্ভবত আরও বেড়ে গেছে।
 
ওই ক্লাবে উপস্থিত সংগঠনের নারীদের অনেকেই চরম আবহাওয়ার কারণে কিছু না কিছু হারিয়েছেন। এঁদেরই একজন ঘূর্ণিঝড় লরায় ঘর হারান। আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, তিনি নিজেকে জলবায়ু সংকটের একজন ভুক্তভোগী বলে মনে করেন কি না। জবাবে তিনি মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, ‘আমার বিশ্বাস করি, আগামী দিনগুলোয় জলবায়ু কেমন হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে ঈশ্বর আমাদের বার্তা দিচ্ছেন।’
 
একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে লুইজিয়ানায় বিমা নিয়েও সংকটও দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে লুইজিয়ানার রিপাবলিকান ইনস্যুরেন্স কমিশনার টিম টেম্পল মূল বক্তব্য দেন। এ সময় অনেক মানুষ অভিযোগ করেন যে তাঁদের বিমার প্রিমিয়ামের হার গত এক বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু টিম টেম্পল এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো বক্তব্যই দেননি। এমনকি একবারও তিনি জলবায়ু সংকট নিয়ে কথা বলেননি। উল্টো এ সংকটের জন্য তিনি বিদ্যমান বিধিবিধানের ওপর দায় চাপান। পরবর্তী সময়ে আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও তিনি জলবায়ুবিজ্ঞানের বিষয়টি বারবার অস্বীকার করে গেছেন।
 
এ ধরনের মনোভাব অঙ্গরাজ্যটিতে জলবায়ু সংকট নিয়ে জনমনে তৈরি হওয়া ধারণার বিষয়ে রক্ষণশীল দলের নেতাদের ভয়াবহ ব্যর্থতাই ফুটিয়ে তোলে। কট্টর ডানপন্থী গভর্নর জেফ ল্যান্ড্রিসহ এসব নেতার কেউ কেউ জলবায়ু সংকট নিয়ে ট্রাম্পের ভাষায় কথা বলছেন। অর্থাৎ এ সংকটকে ভুয়া বলে দাবি করছেন। এবার দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ট্রাম্পের এ ধরনের মনোভাব বজায় থাকবে। এটিই তিক্ত সত্য। গত মাসে ঘূর্ণিঝড় হেলেনের পর ট্রাম্প এ নিয়ে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা চালান। ফলে যাঁরা ট্রাম্পকে ভোট দেবেন, তাঁদেরকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
 
লুইজিয়ানায় সম্ভবত এই ব্যর্থতার জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির ভূমিকা তুলনামূলক কম। গত নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টি এখানে খুব বাজেভাবে হেরে গিয়েছিল। ফলে অঙ্গরাজ্যটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কট্টর ডানপন্থীদের হাতে।
 
তবে এই ক্লাব থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে এর বিরুদ্ধে নতুন করে প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে বলে লক্ষণ দেখা গেছে। স্যাডি সামারলিন নামের একজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। তিনি ক্লে হিগিনস নামে একজন উগ্রপন্থী ও জলবায়ুবিজ্ঞানকে অস্বীকার করা কংগ্রেস সদস্যের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হিগিনস সম্প্রতি এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই অঙ্গরাজ্যে বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণে লাগাম টানতে চাওয়ায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার প্রধানকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো উচিত।
 
স্পষ্টত এটি একটি কঠিন লড়াই হতে চলেছে। তবে রক্ষণশীল দলকে ব্যাপকভাবে ভোট দেয় এমন জনগোষ্ঠীতে প্রগতিশীল রাজনীতি এগিয়ে নেওয়া যাবে না—এমন এ ধারণা ভেঙে দিতে চান সামারলিন। আমরা ঘামঝরানো আর্দ্রতার মধ্যে স্বল্প আয়ের মানুষের বসতি লেক চার্লসে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছি। সামারলিনের পরিবারের সদস্যরা এতে যোগ দিয়ে তাঁর প্রচারের সদস্য দ্বিগুণ করেছেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের ঘূর্ণিঝড়–পরবর্তী সংগ্রামের গল্প শুনছেন।
 
সামারলিন স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা এখানে ঠিকমতো ছিলাম না। আমরা নিজেদের কথাগুলো বলতে পারিনি। আমরা কী বলব আর কী বলব না তা ঠিক করার বিষয়টি রিপাবলিকান পার্টিকে দিয়ে রেখেছিলাম।’
 
সামারলিন আরও বলেন, তাঁর এই প্রচারণার উদ্দেশ্য জয় নিশ্চিত করা নয়, বরং আলাপ-আলোচনা শুরু করা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.