
কনফেত্তির ওড়াউড়ির মধ্যেই সিরিজ জয়ের ট্রফি নিয়ে গ্রুপ ছবি তুলল হাস্যোজ্জ্বল বাংলাদেশ দল, ফটোসাংবাদিকেরা যে ছবির ফ্রেম খুঁজে পেলেন দেড় বছর পর।
ঝিকিমিকি সোনালি কনফেত্তিতে রঙিন হয়ে উঠল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের আবহ। দৃশ্যটা ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণের পর। কনফেত্তির ওড়াউড়ির মধ্যেই সিরিজ জয়ের ট্রফি নিয়ে গ্রুপ ছবি তুলল হাস্যোজ্জ্বল বাংলাদেশ দল, ফটোসাংবাদিকেরা যে ছবির ফ্রেম খুঁজে পেলেন দেড় বছর পর।
২০২৪ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোম সিরিজ জয়ের পর টানা চারটি সিরিজে হার প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল বাংলাদেশের ওয়ানডে সামর্থ্য নিয়েই। গত মঙ্গলবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে সুপার ওভারে হার নতুন করে তুলেছিল সে প্রশ্ন।
মিরপুরে আজ শেষ ম্যাচটা ১৭৯ রানের বড় ব্যবধানে জিতে যেটি মেহেদী হাসান মিরাজের বাংলাদেশ দল আপাতত দূরেই সরিয়ে দিল। ওয়ানডেতে এটি এখন রানের হিসাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় জয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয় সর্বোচ্চ ব্যবধানে।

অস্ট্রেলিয়া থেকে কাল রাতে দেশে ফেরা বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম আজই প্রথম মাঠে বসে দেখেছেন এই সিরিজের ম্যাচ। বাংলাদেশ দলের ইনিংস শেষে প্রেসবক্সে এসে তাঁর রসিকতামাখা মন্তব্য, ‘হঠাৎ করে ব্যাটিং উইকেট হয়ে গেল!’
ইনিংস বিরতি চলছিল বলে মাঠ তখন ফাঁকা। তবে একটু আগেই টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়া বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ২৯৬ রান করে ইনিংস শেষ করেছে। শেষ ম্যাচে যেটি এই সিরিজের আলোচনাটাকেই দিল অন্য দিকে ঘুরিয়ে। আমিনুলের রসিকতা সে সূত্রেই।
শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে স্পিনবান্ধব উইকেট নতুন কিছু নয়। তবে কালো মাটির উইকেটে স্পিন বিষ এবার যেন একটু বেশিই ছিল। প্রথম ওয়ানডের অভিজ্ঞতার পর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোনো পেসারকে বোলিংয়ে আনেনি, বাংলাদেশ দলে একমাত্র পেসার ছিলেন শুধু মোস্তাফিজুর রহমান। পুরো ৫০ ওভার স্পিনারদের দিয়ে করিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মোস্তাফিজের ৮ ওভার বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ৪২ওভারসহ সে ম্যাচে ৯২ ওভার স্পিনারদের করাটাও বিশ্ব রেকর্ড।
সিরিজের শেষ ম্যাচটা হয়েছে ১৮ অক্টোবরের প্রথম ম্যাচের উইকেটে, যেটি ছিল দ্বিতীয় ম্যাচের উইকেটের তুলনায় আরও বেশি স্পিন সহায়ক। দুই দল মাঠেও নামে অপরিবর্তিত একাদশ নিয়ে। কিন্তু আজ আসলেই সেটি নিয়েছিল অন্য চেহারা।

উইকেট থেকে এদিনও যথেষ্ট ভালো টার্ন পেয়েছেন স্পিনাররা। তবে ব্যাটসম্যানদের বিপদে ফেলে বল হঠাৎ নিচু হয়নি বা গতিও হারায়নি। সুষম বাউন্স নিয়ে উঠে আসা বলে ব্যাটিংটাকে দারুণ উপভোগ্য বানিয়ে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার সাইফ হাসান ও সৌম্য সরকার। তাতে ঠিক রেকর্ড না হলেও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা এদিনও ঘটল। তবে অমন টার্নিং উইকেটেও এবার সেগুলোর নায়ক বাংলাদেশের দুই ওপেনার।
২৫.২ ওভার একসঙ্গে থেকে ১৭৬ রানের ওপেনিং জুটি গড়েছেন সাইফ-সৌম্য, যা শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি। অবশ্য ২০২০ সালে তামিম ইকবাল-লিটন দাসের ২৯২ রানের পর ওয়ানডেতেই আজকের ১৭৬ এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি। ২০১৮ সালের জানুয়ারির পর ওয়ানডেতে মিরপুরে বাংলাদেশের প্রথম ৫০ ছোঁয়া উদ্বোধনী জুটিও। আর দলীয় সংগ্রহ ২৯৬ গত সাত বছরের মধ্যে মিরপুরের মাঠে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ।
জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ গুঁড়িয়ে গেছে ১১৭ রানেই। ৩০.১ ওভারের ইনিংসে বল করেছেন শুধু বাংলাদেশের চার স্পিনার, একমাত্র পেসার মোস্তাফিজুর রহমান একটি বলও নয়। বাঁহাতি নাসুম আহমেদ এবং লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন ৩টি করে ও আরেক বাঁহাতি তানভীর ইসলাম এবং অফ স্পিনে অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ নিয়েছেন ২টি করে উইকেট। বড় রানের তাড়ায় একটু তাড়াহুড়া ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংয়ে, যেটির সুযোগ নিয়েছেন বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডাররা।

এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাঁহাতি স্পিনার গুড়াকেশ মোতির করা ১৬তম ওভারে ছক্কা মেরে দলের রান তিন অঙ্কে নিয়ে যান ওই ওভারেরই প্রথম বলে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যাওয়া সাইফ। ওভারের শেষ বলে চার মেরে ওয়ানডেতে নিজের প্রথম ফিফটিও পেয়ে যান তিনি।
সৌম্য পেয়েছেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৪তম ফিফটি। দুই ওপেনারের সৌজন্যে ২০ ওভারেই বাংলাদেশের রান হয়ে যায় বিনা উইকেটে ১৩৯। সৌম্যর চার আর সাইফের ছক্কায় অ্যালিক অ্যাথানেজের ওই ওভারে আসে ১৩। পুরো ইনিংসে মারা ১৪টি ছক্কা ওয়ানডের এক ইনিংসেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড ছুঁয়েছে।
যে জুটিতে এত কিছু, সে জুটির দুই ব্যাটসম্যান কেমন ব্যাটিং করেছেন; তা নিশ্চয়ই এখনো বলা না হলেও বুঝতে পারছেন। যেভাবে খেলছিলেন তাতে সৌম্য-সাইফ দুজনই সেঞ্চুরি পেতে পারতেন। সাইফের ৭২ বলে ৮০ রানের ইনিংসে ৬টি করে চার ও ছক্কা। ২৬তম ওভারের দ্বিতীয় বলে রোস্টন চেজকে আরেকটি ছক্কা মারতে গিয়েই লং অনে জাস্টিন গ্রিভসের হাতে ক্যাচ দেন সাইফ।
সৌম্যর পুরোনো দিন মনে করিয়ে দেওয়া নান্দনিক ইনিংসটি সেঞ্চুরির সুবাস ছড়িয়েছে আরেকটু বেশি। তবে দলের ১৮১ রানে ৪ ছক্কা ও ৭ চারে তাঁর ৮৬ বলে ৯১ রানের ইনিংস শেষ হয়েছে হতাশা ছড়িয়ে।
২৯তম ওভারে আকিল হোসেনের ঝুলিয়ে দেওয়া এক বলে মিডউইকেটে আকিম অগাস্টের হাতে ক্যাচ দেওয়াটা সৌম্য নিজেই মানতে পারছিলেন না। হতাশায় কিছুক্ষণ উইকেটের ওপরই হাঁটু গেড়ে বসে থেকে মাঠ ছেড়েছেন হেলমেট চাপড়াতে চাপড়াতে।

অল্প সময়ের মধ্যে থিতু দুই ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলে যা হয়, সাইফ আর সৌম্যর বিদায়ের পর বাংলাদেশের ইনিংসও গতি হারাতে থাকে। পরের ১১ ওভারে তাওহিদ হৃদয় ও নাজমুল হোসেন মিলে তুললেন ৫০ রান। ৪০তম ওভারে হৃদয় আউট হয়ে গেলে শেষ ১০ ওভারে দ্রুত রান তুলতে আগে পাঠানো হয় রিশাদ হোসেন ও নাসুম আহমেদকে। কিন্তু এই ম্যাচে ক্যারিয়ারের প্রথম ৪ উইকেট নেওয়া আকিল ৪৬তম ওভারেই ফেরান মাহিদুল, রিশাদ ও নাসুমকে।
তারপরও নাজমুলের ৫৫ বলে ৪৪-এর পর শেষ দিকে নুরুল হাসানের এক ছক্কা এক চারে ৮ বলে অপরাজিত ১৬ আর অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের ১৭ বলে ১৭ রানে তিন শর কাছাকাছি চলে যায় বাংলাদেশ। তবে ছয়টি ক্যাচ ফেলে তাতে ‘অবদান’ আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফিল্ডারদেরও।

ম্যাচের স্কোরকার্ডে অবশ্য তার উল্লেখ থাকবে না। থাকবে শুধু বাংলাদেশের জয়ের কথাই, যে জয়ের দুই নায়কের নাম সৌম্য সরকার ও সাইফ হাসান।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৯৬/৮ (সৌম্য ৯১, সাইফ ৮০, নাজমুল ৪৪, হৃদয় ২৮; আকিল ৪/৪১, অ্যাথানেজ ২/৩৭, মোতি ১/৫৩, চেজ ১/৫৩)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৩০.১ ওভারে ১১৭ অলআউট (আকিল ২৭, কিং ১৮, অ্যাথানেজ ১৫, গ্রিভস ১৫, কার্টি ১৫; নাসুম ৩/১১, রিশাদ ৩/৫৪, তানভীর ২/১৬, মিরাজ ২/৩৫)।
ফল: বাংলাদেশ ১৭৯ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: সৌম্য সরকার।
ম্যান অব দ্য সিরিজ: রিশাদ হোসেন।
সিরিজ: ৩ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ২–১ ব্যবধানে জয়ী।