তুরস্কের এবারের জাতীয় নির্বাচনে চরম নাটকীয় পরিস্থিতি দেখা গেছে। দেশটির নিয়ম অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হতে হলে যেকোনো প্রার্থীকে ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হবে। কিন্তু দুই প্রার্থী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও কেমাল কিলিচদারওলু এই মাইলফলক পেরোতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে নির্বাচন গড়িয়েছে দ্বিতীয় দফায়। ২৮ মে এই দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফার ভোট গ্রহণ হবে।
দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে এরদোয়ান ও কেমাল ছাড়াও আরেকটি নাম আলোচনায় উঠে এসেছে। তিনি হলেন সিনান ওগান। প্রথম দফার ভোটে প্রার্থী ছিলেন সিনান। কিন্তু শেষ হাসি হাসতে পারেননি। ভোটের ফলাফলের হিসাবে, তাঁর অবস্থান তৃতীয়। আর এ জন্যই নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে সিনান।
এরদোয়ান নাকি কেমাল—২৮ মে কার ভাগ্য খুলছে, তা নির্ধারণে এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ধরা হচ্ছে সিনানকে। এর কারণ, গত রোববারের নির্বাচনে এরদোয়ান ৪৯ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন। কেমাল পেয়েছেন ৪৫ শতাংশ। আর সিনানের ঝুঁলিতে গেছে ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ভোট।
৫ শতাংশের বেশি ভোট ঝুঁলিতে নিয়ে সিনান এখন ‘কিংমেকার’ হয়ে উঠেছেন। কেননা, সমীকরণ বলছে, দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের আগে সিনান যাঁকে সমর্থন দেবেন, তাঁর জন্য ভোটের বৈতরণী পার হওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। তাই আগামী দুই সপ্তাহ সিনানের দল এরদোয়ান ও কেমালের সঙ্গে দর–কষাকষি চালিয়ে যাবেন।
সিনান ওগান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক। বয়স ৫৫ বছর। এটিএ অ্যালায়েন্সের হয়ে এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। গতকাল সোমবার সিনান বলেন, ‘এবার আমরা কোন প্রার্থীকে সমর্থন দেব, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে যারা সন্ত্রাসবাদ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারে না, তাদের আমাদের কাছাকাছি আসার দরকার নেই।’
শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল, এবারের নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়াতে পারে। তুর্কি জাতীয়তাবাদী আর কেমালপন্থীদের মধ্যে লড়াই জমে উঠতে পারে, এমনটাই বলেছেন সিনান। তবে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের আগে সিনানের কণ্ঠে ‘সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত থাকার’ মন্তব্য বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। কেননা, তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা মনে করেন, এরদোয়ান ও কেমাল—উভয়েই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দেন।
তুরস্কের রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা কেমাল। এবারের নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন দিয়েছে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি)। কুর্দি আন্দোলনের সমর্থক এইচডিপি। সিনানের মতো জাতীয়তাবাদীদের মতে, দলটি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সঙ্গী।
স্বাধীন কুর্দিস্তানের দাবিতে দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে পিকেকে। এ আন্দোলন-সংগ্রামে ১০ হাজারের মতো মানুষের প্রাণ গেছে। তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) পিকেকে দলটিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
অন্যদিকে এরদোয়ানের রাজনৈতিক দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে (একে পার্টি) সমর্থন দিয়ে এসেছে কুর্দিশ ইসলামি দল হুদা-পার। এমনকি একে পার্টির প্রার্থী হয়ে হুদা-পারের তিনজন রাজনীতিক তুরস্কের পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে হুদা-পারের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে পিকেকের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছিল হিজবুল্লাহ। ওই সময় তুর্কি পুলিশের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহর সদস্যরা চরম সহিংস অভিযান চালাতেন।
তুরস্কের ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) সাবেক উপদেষ্টা মুরাত ইলদিজ বলেন, ‘সিনান ওগান শুরু থেকে একটি বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছেন, যিনি সন্ত্রাসবাদীদের সংস্পর্শ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন, তিনি তাঁকেই চূড়ান্ত সমর্থন দেবেন।’
তাই এখন দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে এরদোয়ান ও কেমালের সঙ্গে সিনানের দর–কষাকষির মূল বিষয় হতে পারে সন্ত্রাসবাদ। এ ক্ষেত্রে এরদোয়ানের সঙ্গে আলাচনা চালিয়া যাওয়া সিনানের পক্ষে তুলনামূলক কঠিন হতে পারে বলেও মনে করছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক মুরাত ইলদিজ। মুরাতের মতে, এরদোয়ানের দলের সঙ্গে হুদা-পারের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। এমনকি হুদা-পারের তিনজন রাজনীতিক এখন একে পার্টির হাত ধরে পার্লামেন্টে গিয়েছেন।
ইস্তাম্বুলের সাবানটি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্ক এসেন বলেন, ‘দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছেন বা এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, এমন অনেক ভোটার সিনানের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। জাতীয়তাবাদী এ নেতা যাঁকে সমর্থন দেবেন, তাঁরাও সেই প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে পড়বেন।’
বার্ক এসেন আরও বলেন, ‘তুরস্কের জাতীয়তাবাদী ভোটাররা একদিকে এরদোয়ানের সঙ্গে হুদা-পারের পরম সখ্যতা দেখছেন। অন্যদিকে কেমালের সঙ্গে কুর্দিশ পিকেকের ঘনিষ্ঠতা দেখছেন। তাঁরা যেমন এরদোয়ানকে পছন্দ করতে পারছেন না, তেমনি কেমালকেও একজন দুর্বল নেতা মনে করছেন।’
তাই দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আগে তুরস্কের এই জাতীয়তাবাদী ভোটারদের অনেকেই সিনানের দিকে চেয়ে থাকবেন। সিনান যাঁকে সমর্থন দেবেন, তাঁর পক্ষেই ব্যালটে সিল পড়তে পারে। এ কারণে সিনান ওগান এখন তুরস্কের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ মুখ বিবেচিত হচ্ছেন। বলা হচ্ছে, এরদোয়ান নাকি কেমাল—কে হাসবেন শেষ হাসি, সেটার অনেকটাই নির্ভর করছে সিনানের সমর্থনের ওপর।