এবার ইউক্রেনের হামলা ঠেকাতে ব্যস্ত রাশিয়া, ‘সংকটে’ মস্কো

0
112
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম৭৭৭ হোইৎজার কামান থেকে গোলা ছুড়ছেন ইউক্রেনের সেনারা, ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর ৭৬ সপ্তাহে এসে বেশ কিছু অগ্রগতি পেয়েছে কিয়েভ। মস্কো লক্ষ্য করে একাধিক ড্রোন হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে ইউক্রেন বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া রাশিয়ার জাহাজেও হামলা চালিয়েছে দেশটি।

হামলার শিকার রাশিয়ার একটি জাহাজের নাম ওলেনেগোরস্কি গোর্নইয়াক।

কৃষ্ণসাগরের পূর্ব উপকূলে নভোরোসিয়াক পোতাশ্রয়ের বাইরে জাহাজটিতে হামলা চালানো হয়। পোতাশ্রয়টি রাশিয়ার জন্য নিরাপদ বলেই মনে করা হয়। কারণ, এ অঞ্চলে রাশিয়ার নৌবহরের বেশির ভাগ জাহাজই সেখানে মোতায়েন করা রয়েছে। ৪ আগস্ট ওই হামলার একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়।

ইউক্রেনের এই হামলার পর রাশিয়া বড় সংকটের মধ্যে পড়েছে বলে মনে করেন স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফিলিপস ওব্রিয়েন। তাঁর প্রশ্ন, ‘কৃষ্ণসাগর পাড়ি দেওয়া তেলবাহী এবং এ ধরনের জাহাজগুলোর সুরক্ষার জন্য রাশিয়া কি আরও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করবে? তবে এতে ওই যুদ্ধজাহাজগুলোও (ইউক্রেনের) লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে নাকি ইউক্রেনের উপকূলজুড়ে হামলার চেষ্টা করবে রাশিয়া? যদিও এটা রুশ বাহিনীর জন্য কতটা বিধ্বংসী, তা ইতিমধ্যেই দেখেছে মস্কো।’

ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর মুখপাত্র ইউরি ইগনাত জানিয়েছেন, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার প্রায় ১ হাজার ২০০ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন বাহিনী। আর দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ভাষ্যমতে, তাঁরা ২ হাজারের বেশি রুশ ড্রোন ধ্বংস করেছেন।

ওলেনেগোরস্কি গোর্নইয়াক নামের জাহাজটি তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এবং শিগগিরই তা মেরামত করা হবে বলে জানিয়েছে রুশ সূত্রগুলো। তবে ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দারা বলছেন উল্টো কথা। তাঁরা জানিয়েছেন, হামলায় জাহাজটির বড় ক্ষতি হয়েছে। একই তথ্য দিয়েছেন ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মুখপাত্র আন্দ্রি ইউসভ।

কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার একটি তেলবাহী ট্যাংকারে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন
কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার একটি তেলবাহী ট্যাংকারে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন, ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

সামুদ্রিক ড্রোন দিয়ে ওলেনেগোরস্কি গোর্নইয়াকে হামলার দিন রাতেই রাশিয়ার জ্বালানি তেলবাহী আরেকটি ট্যাংকারে ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। এতে ওই ট্যাংকারটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, হামলাটি চালানো হয়েছিল ক্রিমিয়ার কার্চ সেতুর ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণে। ওই সেতুতে আগে দুইবার হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন।

যুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলের সম্মুখসারিতে ইউক্রেনের অগ্রগতি ধীরে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর সহায়তাকারী বাহিনীগুলোর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দিমিত্র গেরেগা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন রাশিয়ার পোঁতা মাইন, পরিখা, ট্যাংকবিরোধী কংক্রিটের ব্যারিকেড ও কাঁটাতারের বেড়ার কথা।

রাশিয়ার ভূখণ্ডের কাছের বন্দরগুলোয় দেশটির সামরিক ও পণ্যবাহী জাহাজগুলোয় এ ধরনের হামলা চলতে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। ইউক্রেনের নাবিকদের কাছে দেশটির স্টেট হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভিসের পাঠানো এক বার্তায় কার্চ প্রণালি থেকে সোচি শহর পর্যন্ত কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার বন্দরগুলোকে ‘সামরিক হুমকি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়্যারের ভাষ্যমতে, আগে স্থলে থাকা রুশ সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করেই মূলত হামলা চালাচ্ছিল ইউক্রেন। তবে এখন মনে হচ্ছে, তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে রাশিয়ার নৌবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে।

আগে ইউক্রেনের হামলা বলতে গত বছর সেপ্টেম্বরে খারকিভ ও খেরসন অঞ্চলে দেশটির বাহিনীর অগ্রগতির কথা বুঝিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়্যার। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ইউক্রেন এখন রুশ ভূখণ্ডের ভেতরের দিকের অংশে হামলা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে রুশ জলযানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে।

কিয়েভের হামলা ও রাশিয়ার প্রতিশোধ

রাশিয়ার ভূখণ্ডের ভেতরের অংশে দেশটির বিভিন্ন সরবরাহ পথে হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ১ আগস্ট ক্রিমিয়ার একটি সৈকতে ২০০ রুশ সেনার ওপর হামলা চালাতে হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল তারা।

পরে ৪ আগস্টের ভিডিওতে দেখা গেছে, ক্রিমিয়ার ফেওদোসিয়া শহরে জ্বালানি তেলের একটি গুদামের কাছে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা চলছে। এরপর রাশিয়া দাবি করেছিল, তারা ইউক্রেনের পাঠানো ১৩টি ড্রোনের সব কটি ধ্বংস করেছে।

‘কৃষ্ণসাগর পাড়ি দেওয়া তেলবাহী ও এ ধরনের জাহাজগুলোর সুরক্ষার জন্য রাশিয়া কি আরও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করবে? তবে এর ফলে ওই যুদ্ধজাহাজগুলো (ইউক্রেনের) লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে নাকি ইউক্রেনের উপকূলজুড়ে হামলার চেষ্টা করবে রাশিয়া? যদিও এটা রুশ বাহিনীর জন্য কতটা বিধ্বংসী, তা ইতিমধ্যেই দেখেছে মস্কো’

—ফিলিপস ওব্রিয়েন, অধ্যাপক, সেন্ট অ্যান্ড্রুস ইউনিভার্সিটি

এর দুই দিন পরে হেনিচেস্ক প্রণালির ওপরে একটি সেতুতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করে ইউক্রেন। ক্রিমিয়া থেকে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডকে যুক্ত করেছে এই সেতুটি। আর চোনহার সেতু নামের কাছেই আরেকটি সেতুতে দ্বিতীয়বারের মতো হামলা চালানো হয়। রসদ সরবরাহের জন্য এই সেতু রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এ নিয়ে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলের মুখপাত্র নাতালিয়া হুমেনিউক বলেন, ইউক্রেনের হামলার কারণে রাশিয়া তাদের পথ বদলে ক্রিমিয়ার পশ্চিম দিক দিয়ে পণ্য ও সেনা সরবরাহ করতে বাধ্য হয়েছে। এতে তাদের চলাচল সম্পর্কে অনুমান করা ইউক্রেনের জন্য সহজ হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে তারা হামলার ঝুঁকির মুখেও পড়েছে।

এদিকে রাশিয়া বিপুল পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইউক্রেনের এসব হামলার জবাব দিয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাশিয়ার ছোড়া ২৭টি শাহেদ ড্রোনের সব কটি, ২০টি কালিবার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৭টি এবং ২৩টি কেএইচ–১০১/৫৫৫ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৩টি ঠেকিয়ে দিয়েছে তারা।
ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর মুখপাত্র ইউরি ইগনাত জানিয়েছেন, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার প্রায় ১ হাজার ২০০ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন বাহিনী। আর দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ভাষ্যমতে, তাঁরা ২ হাজারের বেশি রুশ ড্রোন ধ্বংস করেছেন।

পূর্ব ও দক্ষিণ সম্মুখসারিতে অগ্রগতি

ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী হানা মালিয়ার জানিয়েছেন, কিছু এলাকায় দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনী রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রথম স্তর ভেঙে দিয়েছে। সেখানে ইউক্রেনের সেনারা রুশ বাহিনীর ভেতরের স্তরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছেন।
অগ্রগতির বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন ইউক্রেনের সেনা কর্মকর্তা কর্নেল মিকোলা উরশালোভিচ। তিনি বলেন, মেলিতোপোলের দিকে যু্দ্ধের সম্মুখসারিতে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত যে দেড় কিলোমিটার এলাকা রয়েছে, সেখানে ৩ আগস্ট ৬৫০ মিটার পর্যন্ত এগিয়েছে ইউক্রেন বাহিনী।

গত বছরের অক্টোবরে ক্রিমিয়ার কার্চ সেতুতে হামলা চালানো হয়।ছবি: রয়টার্স

তবে যুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলের সম্মুখসারিতে ইউক্রেনের অগ্রগতি ধীরে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর সহায়তাকারী বাহিনীগুলোর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দিমিত্র গেরেগা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, রাশিয়ার পুঁতে রাখা মাইন, পরিখা, ট্যাংকবিরোধী কংক্রিটের ব্যারিকেড ও কাঁটাতারের বেড়ার কথা। ১০ থেকে ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। দিমিত্র গেরেগা বলেন, ইউক্রেনের আরও মাইনবিরোধী সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত সেনা লাগবে।

একই কথা ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান কিরিলো বুদানভের। তাঁর ভাষ্য, রুশ বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলে শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ইউক্রেন বাহিনী পূর্বাঞ্চলে বেশি অগ্রগতি পেয়েছে।

সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক নিবন্ধে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য ইউক্রেন বাহিনী ধীরে এগোচ্ছে। তারা রুশ কামানগুলো থেকে গোলা ছোড়ার জন্য উসকানি দিচ্ছে। তারপর সেগুলোর অবস্থান শনাক্ত করে ধ্বংস করছে। এটা যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর মতো একটি কৌশল। এর জেরে রুশ বাহিনীর অবস্থানগুলো দখলে নিচ্ছে ইউক্রেন।

সৌদি সম্মেলন

যুদ্ধ ঘিরে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে কূটনৈতিক পদক্ষেপও নিচ্ছে ইউক্রেন। আগে থেকেই দেশটি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়াকে পাশে পেয়েছে। এরই মধ্যে ৬ আগস্ট সৌদি আরবে ৪২ দেশের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানাতে ওই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।

সৌদি আরবের ওই সম্মেলন ছিল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমি পুতিনের গালে চপেটাঘাতের মতো। কারণ, মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে আফ্রিকার নেতাদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। রাশিয়ার খাদ্যশস্য ও সার রপ্তানিতে গতি আনতেই ওই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।

রুশ প্রেসিডেন্টের ওই পদক্ষেপের অর্থ মস্কোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো দেশটির অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আর রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলতি বছরে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করে ১০০ বিলিয়ন ডলার করা হয়েছে। এই অর্থ দেশটির মোট বাজেটের তিন ভাগের এক ভাগ। এতে রুশ অর্থনীতি বড় চাপে পড়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.