এমবাপ্পের বাবা উইলফ্রিড এমবাপ্পে, মা ফায়েজা লামারি। দুজনের জীবনই তখন আবর্তিত হচ্ছিল খেলাধুলাকে ঘিরে। বাবা বঁদি শহরের পরিচিত ফুটবল কোচ। আর মা হ্যান্ডবল প্লেয়ার হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন। পরিবারের সবার পেশাই ছিল খেলাধুলা।
উইলফ্রিড এমবাপ্পে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনের মানুষ। তাঁর পূর্বপুরুষেরা নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত। মা ফায়েজা আলজেরীয়। ফরাসি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ লাভের জন্য উইলফ্রিড আলজেরীয়-ফরাসি নারী ফায়েজাকে জীবনসঙ্গিনী করেন।
এমবাপ্পের শিশুকাল ততটা আনন্দে কাটেনি। যে শহরতলিতে তাঁর জন্ম, সেই বঁদিতে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লেগেই থাকত। ২০০৫ সালের দাঙ্গার দগদগে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারবে না সেখানকার বাসিন্দারা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বহু সরকারি ভবন, গাড়ি। প্যারিসের ভদ্রজনেরা তখন শহরটিকে দেখতেন অপরাধ ও সন্ত্রাসের লীলাক্ষেত্র হিসেবে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য শহরটির ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন আসে। এর জন্য এমবাপ্পের ভূমিকা আছে বৈকি!
বৈরী পরিবেশে থেকে বালক এমবাপ্পের পা হড়কে যেতে পারত কুপথে। কিন্তু তা হতে দেননি উইলফ্রিড। ছেলের নিউরনে তিনিই ফুটবলের অনুরণন ঘটান। তাতে কাজ হয়। এক সময়ে দেখা গেল, ঘরটাকেই মাঠ বানিয়ে ফেলেছেন শিশু এমবাপ্পে। এমনকি ঘুমানোর সময়ও পাশে ফুটবল রাখতেন। ফুটবলকে বালিশ বানিয়ে ঘুমাতেন। বাবার কথায়, ‘২৪ ঘণ্টাই ফুটবলে বুঁদ থাকত ছেলে। কখনো টানা চার-পাঁচটি ম্যাচ দেখে ফেলত। একদম ক্রেজি।’
৬ থেকে ১১ বছর পর্যন্ত সংগীত স্কুলে গেছেন এমবাপ্পে। ফুটবলের পর সংগীত তাঁর দ্বিতীয় আবেগ। গান গেয়ে বঁদির টাউন হল পার্কে দর্শকের হাততালিও পেয়েছেন। তবে প্রচলিত লেখাপড়া হয়নি তাঁর। বাবা উইলফ্রিড বাড়িতে শিক্ষক রেখে কিছু লেখাপড়া করিয়েছেন।
ছয় বছর বয়সেই এএস বঁদি ক্লাবে বাবার হাতেই ফুটবলের হাতেখড়ি এমবাপ্পের। ছোট্ট বয়সেই নিখুঁত ফিনিশিং, গতি ও দ্রুত বল ডিব্রলিংয়ের দক্ষতা অর্জন করেন। সে সময় তাঁর আরেকজন কোচ আন্তনিও রিকার্দির কথায়, ‘প্রথমবারের মতো আমি যখন তাকে কোচিং করাই, আপনি বলতে পারেন, সে ছিল অন্য সবার চেয়ে আলাদা। অসাধারণ ড্রিবলিং, গতি ছিল অন্য সবার চেয়ে বেশি। ১৫ বছর ধরে বাচ্চাদের কোচিং করিয়েছি, এর মধ্যে সে-ই ছিল সেরা। প্যারিসে অনেক প্রতিভাকে আমি জানতাম, কিন্তু এমবাপ্পের মতো একজনকেও দেখিনি।’
একজন এমবাপ্পে তৈরি হওয়ার পেছনে কঠোর অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা আর ত্যাগ স্বীকারের গল্প থাকে এর পেছনে। ফুটবলের বাইরের সময়টা আর দশটা শিশুর মতো কাটানোর সুযোগ তাঁর ছিল না। বন্ধুদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান বা শিশুদের কোনো পার্টিতে এমবাপ্পেকে নিয়ে যাননি মা-বাবা। তার বদলে তাঁরা ভিন্ন এক কৌশল গ্রহণ করেন। তাঁরা চেষ্টা করেন এমবাপ্পেকে ছোটবেলাতেই ফরাসি ফুটবল কিংবদন্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাতে, যেন তার স্বপ্নটা বড় হয়।
শুরুতে তাঁরা চেষ্টা করেন সে সময়ের তারকা ফুটবলার থিয়েরি অঁরির সঙ্গে ছেলেকে সাক্ষাৎ করাতে। তাঁদের চেষ্টা সফল হয়। ৫ বছরের এমবাপ্পের সঙ্গে ছবি তোলেন আর্সেনাল তারকা। অঁরি কি তখন জানতেন, এই ছোট্ট ছেলেটি একদিন তাঁর করা দুটো জাতীয় রেকর্ড ভেঙে ফেলবে?
এরপরই ছোট্ট ছেলেটি দেখা পায় তাঁর মায়ের দেশে জন্ম নেওয়া জিনেদিন জিদানের। রিয়াল মাদ্রিদ তারকা কি তখন বুঝেছিলেন, চ্যাম্পিয়নস লিগে করা তাঁর রেকর্ড খোয়া যাবে এই পুঁচকে ছেলেটির কাছে? প্রসঙ্গত, জিনেদিন জিদান আলজেরীয় বংশোদ্ভূত ফরাসি।
সে দিনগুলোতে বাবা উইলফ্রিডই ছিলেন এমবাপ্পের শিক্ষক, মেন্টর—সবকিছু। বাবা-ছেলে প্রায়ই স্তাদ রেঁনে ক্লাবে যেতেন, যেখানে খেলত এমবাপ্পের ভাই জিরেস কেম্বো-এনকোকো। এনকোকো ছিলেন উইলফ্রিডের দত্তক নেওয়া সন্তান। এ সময় উইলফ্রিড অনুভব করেন, এমবাপ্পেকে এএস বঁদির চেয়ে আরও বড় ক্লাবে নেওয়া দরকার। এভাবে ভাইয়ের ক্লাব স্তাদ রেঁনের অনূর্ধ্ব-১২ দলে একটি টুর্নামেন্ট সামনে রেখে সুযোগ পান এমবাপ্পে। তাঁর একক নৈপুণ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় দলটি। তখন স্তাদ রেঁনে ক্লাব এমবাপ্পেকে স্থায়ীভাবে পাওয়ার চেষ্টা করে। উইলফ্রিড-ফায়েজা দম্পতির কাছে প্রতিনিধি পাঠায় ক্লাবটি। তাঁরা সম্মত হননি। কারণ, শিশু এমবাপ্পের চোখে তখন আরও বড় স্বপ্ন।
একদিন সত্যিই এমবাপ্পের সুযোগ হয় ফরাসি জাতীয় ফুটবল স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। তিনি চলে যান ক্লেয়ারফন্তেইনে, সেখানে জাতীয় ফুটবল দলের স্কুলে তাঁর নতুন জীবন শুরু হয়। এই স্কুল সেই স্কুল, যারা সারা দেশের তরুণ প্রতিভাদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দেয়। গড়ে দেয় ভবিষ্যতের ভিত্তি। সে সময় থিওরি অঁরি, নিকোলাস আনেলকা, হাতেম বেন আরফা মতো তারকাদের সঙ্গে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে ফুটবল প্রতিভা আরও এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পান। এ সময়ই তিনি চেলসি, রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখ, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাবের নজরে আসেন। ক্লাবগুলো তাঁকে ট্রায়ালে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু চেলসি ও রিয়াল মাদ্রিদে গিয়েও যেকোনো কারণেই হোক, তাঁর সুযোগ হয়নি। এমবাপ্পে নাম লেখান ফরাসি ক্লাব মোনাকোতে। ২০১৬-১৭ সেশনে তাঁর ২৬ গোল মোনাকোকে লিগ আঁ শিরোপা জিততে সহায়তা করে।
২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ ইউরোয় চোখধাঁধানো নৈপুণ্য দেখিয়ে দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্স দলে ডাক পান ২০১৭ সালে। তারই পথ ধরে পরের বছর রাশিয়া বিশ্বকাপে। রাশিয়া বিশ্বকাপে ফরাসি জাতীয় দলের হয়ে গতির ঝলকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ১৯ বছর বয়সী এমবাপ্পে। আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে তাঁর সেই জোড়া গোলের দুর্ধর্ষ ম্যাচের কথা কে ভুলতে পেরেছে!
এরপর ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আতোঁয়ান গ্রিজম্যানের সঙ্গে জুটি গড়ে গোল করে ফ্রান্সকে শিরোপা এনে দেন এমবাপ্পে। সেই গোলের মধ্য দিয়ে মহাতারকা পেলের পাশে নিজের নাম লেখান, বিশ্বকাপ ফাইনালে দ্বিতীয় টিনএজার হিসেবে গোল করে। সেবার সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কারও জেতেন এমবাপ্পে।
এর পর থেকে কখনো পিএসজির হয়ে, কখনো জাতীয় দলের হয়ে একের পর এক কীর্তি গড়ে চলেছেন ২৪ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড। এই বয়সেই যেসব রেকর্ড ইতিমধ্যে গড়েছেন, তাতে এক সময়ে মেসি, রোনালদো, নেইমারকে ছাড়িয়ে যাবেন—এমন সম্ভাবনার কথাই শোনাচ্ছেন ফুটবল-বিশ্লেষকেরা।