এবার লন্ডনে টিউলিপের বোনকে দেওয়া বিনা মূল্যের ফ্ল্যাটের সন্ধান

0
8
টিউলিপ সিদ্দিক, ছবি: টিউলিপের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে দেশটির ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক (৪২) পরিবারের আরেকটি বিনা মূল্যে পাওয়া ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে। গতকাল শনিবার যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য সানডে টাইমস-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

টিউলিপ বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের (ট্রেজারি) অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি)। মন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশটির আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্বে আছেন। তিনি বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে।

দ্য সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডের এমন একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন, যেটি তাঁর পরিবারকে দিয়েছেন তাঁর খালা শেখ হাসিনার এক মিত্র। হ্যাম্পস্টেডের ফিঞ্চলে রোডের এই ফ্ল্যাট টিউলিপের বোন আজমিনাকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল।

গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনাকে ‘গণহত্যা, হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। এই অভিযোগের মধ্যে অন্তত ৮০০ বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর বিষয়টি আছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও তহবিল তছরুপের অভিযোগও রয়েছে।

শেখ হাসিনা পরিবারের যেসব সদস্য সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগে বলা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে টিউলিপও আছেন। তবে তিনি কোনো অন্যায়-অনিয়ম করার কথা অস্বীকার করে আসছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, টিউলিপের ওপর তাঁর আস্থা রয়েছে।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি ২০০৯ সালে আজমিনাকে হস্তান্তর করেন বাংলাদেশি আইনজীবী মঈন গণি। তিনি শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবি আছে।

যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধনসংক্রান্ত নথিপত্রে বলা হয়েছে, অর্থ বা আর্থিকমূল্য রয়েছে, এমন কিছু ছাড়াই ফ্ল্যাটটি আজমিনাকে দেওয়া হয়েছে।

ফ্ল্যাট হস্তান্তরের সময় আজমিনার বয়স ছিল ১৮ বছর। তখন তিনি অক্সফোর্ডে পড়াশোনা শুরু করতে যাচ্ছিলেন।

টিউলিপ ঠিক কখন ফ্ল্যাটটিতে উঠেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে টিউলিপ ওয়ার্কিং মেনস কলেজের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি নথিতে তাঁর ঠিকানা হিসেবে ফ্ল্যাটটি তালিকাভুক্ত করেন।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ক্যামডেন আর্টস সেন্টারের ট্রাস্টি হওয়ার পর, ২০১৪ সালের মার্চে হ্যাম্পস্টেড ওয়েলস অ্যান্ড ক্যাম্পডেন ট্রাস্টের ট্রাস্টি হওয়ার পরও তিনি একই ঠিকানা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া তাঁর স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সি ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত এটিকে তাঁর ঠিকানা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন। তখন টিউলিপ হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নের লেবার এমপি ছিলেন।

টিউলিপের বোন আজমিনার টনি ব্লেয়ার’স ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি সম্প্রতি শিশুদের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছেন। তিনি ফ্ল্যাটটি ২০২১ সালে ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেন।

ফ্ল্যাটটির আগের মালিক আইনজীবী মঈন গণি আন্তর্জাতিক বিরোধসংক্রান্ত বিষয়ে কয়েক বছর বাংলাদেশের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২১ সালে শেখ হাসিনার তৎকালীন সরকার বিশ্বব্যাংকের একটি প্যানেলে দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে মনোনীত করেছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, শেখ হাসিনার কাছ থেকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ-সংবলিত একটি ব্যক্তিগত চিঠি পাওয়াটা তাঁর জন্য সম্মানের বিষয়।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি থেকে ভিন্ন। কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি ২০০৪ সালে টিউলিপ বিনা মূল্যে পান। তিনি এখনো এই অ্যাপার্টমেন্টটির মালিক।

গত শুক্রবার যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, কিংস ক্রস এলাকার কাছের অ্যাপার্টমেন্টটি টিউলিপকে বিনা মূল্যে দিয়েছিলেন আবদুল মোতালিফ নামের একজন আবাসন ব্যবসায়ী। তিনি শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের সহযোগী।

হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটির বিষয়ে টিউলিপ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁর বোনের এই ফ্ল্যাটটিতে বসবাস করেছিলেন, যা অনেক পরিবারের জন্য সাধারণ একটি বিষয়।

২০১৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত একটি পারমাণবিক শক্তি চুক্তিতে টিউলিপ মধ্যস্থতা করেছেন, এই চুক্তি থেকে লাভবান হয়েছেন বলে যে অভিযোগ, তা অনুসন্ধান করার কথা সম্প্রতি জানায় বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের এই ঘোষণার পর টিউলিপ তদন্তের মুখে। তবে টিউলিপ বলেছেন, তিনি ভুয়া অভিযোগের ভুক্তভোগী।

আওয়ামী লীগের সদস্যদের মালিকানাধীন বা উপহার দেওয়া বাড়িতে টিউলিপ ও তাঁর নিকট পরিবারের বসবাস করার ঘটনা শুধু এই দুটিই নয়।

২.১ মিলিয়ন পাউন্ডের ম্যানসন

টিউলিপ উত্তর লন্ডনের ফিঞ্চলেতে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি ম্যানসনে থাকেন। এটি আগে লরেন পোপ নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন ছিল। তিনি একজন রিয়েলিটি টিভি তারকা। কিন্তু দুই বছর আগে আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার কার্যনির্বাহী সদস্য আবদুল করিম নাজিমের মালিকানাধীন একটি কোম্পানি এটি কিনে নেন।

নাজিম ২০২২ সালে টিউলিপের কাছে বাড়িটি ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। পরের বছর শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা যায়। তাঁকে শেখ হাসিনা সরকার বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) করে। তাঁকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত একটি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়।

টিউলিপ বর্তমানে যে বাড়িতে থাকছেন, সেটির মালিকানা কোম্পানিটি আইনি বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করেছে।

একটি সূত্র বলেছে, টিউলিপ নিরাপত্তার কারণে নাজিমের বাড়িতে ওঠেন। নিরাপত্তার কারণেই সেখানে তিনি থাকছেন। টিউলিপের মুখপাত্র বলেন, তিনি ও তাঁর স্বামী বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হারে ভাড়া দিয়ে থাকেন।

গোল্ডার্স গ্রিনে ১.২ মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়ি

টিউলিপের মা শেখ রেহানা উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনের একটি বাড়িতে থাকেন। অনুসন্ধানী সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট নেত্র নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, এটির মালিক সায়ান রহমান। তিনি শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টার (সালমান এফ রহমান) ছেলে। শেখ হাসিনার পতনের পর সায়ান রহমানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। একটি ব্যাংকের বোর্ড থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়। তাঁর বাবা এখন কারাগারে আছেন।

হ্যাম্পস্টেডে ৫ লাখ পাউন্ডের ফ্ল্যাট

টিউলিপের বোন ও মা হ্যাম্পস্টেডের উল্লিখিত ফ্ল্যাটটির কাছের একটি ফ্ল্যাটে কিছু সময়ের জন্য বসবাস করেছিলেন। এটি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফর উল্লাহর মালিকানাধীন। তিনি এটি ২০০৭ সালে কিনেছিলেন। ২০১২ সালে ৪ লাখ ৯৯ হাজার পাউন্ডে এটি তিনি বিক্রি করে দেন।

আশ্চর্যজনকভাবে আইনজীবী গণিও এটিকে কয়েক বছর ধরে তাঁর ঠিকানা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিলেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.