এবার ঢাকায় ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ ছয় ঘণ্টা

0
121
ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ ছয় ঘণ্টা

রাজধানীতে কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস সেবা আংশিক বন্ধ করে দিয়েছে ভারতীয় কোম্পানি স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। বকেয়া টাকা আদায়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানিটি। এর আগে চট্টগ্রামে তারা সেবা বন্ধ করলেও পরে আবার চালু করে।

ডায়ালাইসিসে সরকারি সেবার পাশাপাশি চুক্তির ভিত্তিতে জড়িত আছে স্যানডোর। ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি হাসপাতালে সেবা দিচ্ছে তারা। মোট ডায়ালাইসিসের ১০ শতাংশ করছে তারা।

গতকাল রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে সেবা ছয় ঘণ্টা বন্ধ রাখে তারা। এটা অব্যাহত থাকতে পারে বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এতে সেবা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়।

জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে নিয়োজিত স্যানডোরের ব্যবস্থাপক নিয়াজ খান বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মিলে সরকারের কাছে বকেয়া ৩০ কোটি টাকা। বকেয়া পরিশোধে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ চিঠিতে ঢাকায় ২১ জানুয়ারির পর সেবা বন্ধের কথা বলা হয়। কিন্তু এখনও সাড়া পাচ্ছেন না। টাকা না পেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য সেবা বন্ধ হতে পারে।

এত টাকা কীভাবে বকেয়া- জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবছর সরকারের সঙ্গে ১৯ হাজার ৮০০ সেশন ডায়ালাইসিস করার চুক্তি হয়। তবে রোগী বৃদ্ধির কারণে এখন বছরে ৭০ থেকে ৮০ হাজারে ঠেকেছে। এই টাকাটাই মূলত বাকি।

তবে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. আক্তারুজ্জামান বলেন, কিছু টাকা বকেয়া থাকলেও এভাবে সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না স্যানডোরের। সরকার তো টাকা দিয়েই এসেছে। হয়তো একটু সময় লাগছে; কিন্তু দেবে। ঢাকায় জাতীয় কিডনি রোগ ইনস্টিটিউটে ৬৯টি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৫টি মেশিনে সেবা দেয় স্যানডোর। রোগীদের কাছ থেকে সরকারি খরচের কাছাকাছি অর্থ নেয় তারা। বাড়তি খরচ সরকার ভর্তুকি হিসেবে স্যানডোরকে দেয়। দেশের সরকারি হাসপাতালে প্রতি সেশনে খরচ হয় সাধারণত ৪০০ টাকা। আর স্যানডোর নেয় ৫৩৫ টাকা। তবে চুক্তি অনুযায়ী বছরে ৫ শতাংশ দাম বাড়ায় স্যানডোর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল এবং বেশিরভাগ রোগীই এটি বহন করতে পারেন না। ডায়ালাইসিস ছাড়াও এ ধরনের রোগীদের রক্ত ??উৎপাদন ও সঞ্চালন বজায় রাখার জন্য ব্যয়বহুল ওষুধ এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ রোগী তা পারেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন। তাঁদের মধ্যে ৪০ হাজারের মতো মানুষের ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়। মাত্র ১০ হাজার মানুষ এই সুযোগ পান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজিস্টদের সম্প্রতি করা এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত প্রায় ৪০ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিস করতে পারেন না।

ডায়ালাইসিস শুরু করে ৯০ শতাংশ রোগী অর্থাভাবে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। এ রোগীর প্রায় ৫০ শতাংশ দুই বছরের মধ্যে মারা যান। ডায়ালাইসিস প্রয়োজন- এমন রোগীর মাত্র ১ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ পান।

সরেজমিন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়েও এর প্রমাণ মেলে। নেফ্রোলজি বিভাগে দিনে ৬০ জনের বেশি রোগীর ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে। তাঁদের ৯০ শতাংশই তিন থেকে চার মাস এ সেবা নেওয়া শুরু করেছেন। এই হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, অধিকাংশ রোগী ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেন এবং এক বছরের মধ্যে অনেকেই মারা যান।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বছরে নতুন করে ৪০ হাজার মানুষের কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। এ রোগীদের মধ্যে অনেককে প্রায়ই বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তাঁরা জীবনের শেষ পর্যায়ে গভীর বিষণ্ণতায় ভোগেন। মানুষের জীবনযাপন পরিবর্তন হওয়ায় গত কয়েক বছরে এমন রোগী বেশি মিলছে। বেড়েছে ডায়ালাইসিসের দামও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলে দেশে ১৩০টি ডায়ালাইসিস সেন্টার রয়েছে। সব মিলিয়ে ৭০০টি ডায়ালাইসিস মেশিনে দৈনিক ১০ হাজার রোগীর সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর বেশিরভাগ ঢাকায়। রাজধানীর বাইরে ডায়ালাইসিসের সুযোগ তেমন নেই। এ ছাড়া সরঞ্জাম আমদানি এবং কিছু ওষুধের খরচ বেশ উচ্চ।

কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য সরকার নির্ধারিত কোনো ফি নেই। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে একক ডায়ালাইসিসের খরচ ৪০০ টাকা থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগে।

‘মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা’: কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের বাসিন্দা আইয়ুব মিয়া রাজধানীতে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ২০০৭ সালে প্রস্রাবে জটিলতা দেখা দেয় তাঁর। ঘুমের মধ্যে প্রস্রাব বের হয়ে বিছানা ভিজে যেত। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানান, তাঁর দুটি কিডনিই নষ্ট। ওষুধ সেবনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তিনি।

জটিলতা বাড়ায় গত বছর জানুয়ারিতে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, তাঁর দুটি কিডনি প্রায় ৮০ শতাংশ কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করা। শুরুতে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস করিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েন তিনি। এক বছরেই ১৫ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। নিজের জমি ও স্ত্রীর অলংকার বিক্রির পাশাপাশি পরিবারের সঞ্চয়ও ফুরিয়ে গেছে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বিনামূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা পেতে আবেদন করেছেন ৫০ বছর বয়সী আইয়ুব মিয়া। বললেন, বেঁচে থাকতে হলে ডায়ালাইসিস করতে হবে। এ জন্য মানুষের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর উপায় নেই। স্ত্রী বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। টাকা জোগাড় না করতে পারলে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

একই অবস্থা রাজধানীর গাবতলীর লালা মোহাম্মদের। ছয় বছর আগে কিডনি জটিলতা দেখা দেয়। ওষুধের মাধ্যমে নিবারণ করার চেষ্টা করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য দুইবার বিদেশেও গিয়েছেন গাড়ির মেকানিক লালা। তাতেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় গত বছর জুনে ডায়ালাইসিস শুরু করেছেন। এরই মধ্যে ২০ লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে।

রোগীদের নিজ খরচে ওষুধ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনতে হয়, যা সামগ্রিক ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেয়। এই রোগীদের বেশিরভাগের সাধারণত সপ্তাহে দুই বা তিনবার ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। বেসরকারি পর্যায়ে সবচেয়ে কম খরচে ৫০০ টাকায় রাজধানীর গণস্বাস্ব্য নগর হাসপাতাল ডায়ালাইসিস পরিচালনা করা হয়।

গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রতি সেশনে ৫০০ টাকা হারে ডায়ালাইসিস করতে হলে প্রতি মাসে নূ্যনতম ২০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। ফলে বেশিরভাগ রোগী ডায়ালাইসিস চালিয়ে যেতে পারেন না। সারা পৃথিবীতে কিডনিসহ নানা জটিল রোগের চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহন করে। তবে দেশে সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্পের আওতায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যানডোর ডায়ালাইসিস সেন্টারগুলো পরিচালনা করে। সরকার জনপ্রতি ২ হাজার ৪০০ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এ খাতে প্রশিক্ষিত পেশাদারদের অভাবও এই চিকিৎসার অসাধ্য হওয়ার একটি বড় কারণ। সারাদেশে দুই কোটি কিডনি রোগীর চিকিৎসার জন্য মাত্র ৩০০ জন নেফ্রোলজিস্ট রয়েছেন।

কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশিদ বলেন, কিডনি রোগী বাড়লেও ডায়ালাইসিস সেবার সক্ষমতা বাড়েনি। মাত্র ২০ শতাংশ কিডনি রোগীকে ডায়ালাইসিস সুবিধা দেওয়া যায়। বাকিরা বিনা চিকিৎসায় অকালে মারা যান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, ডায়ালাইসিস সেবার প্রসারে সরকার প্রতিটি জেলায় ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপনে কাজ করছে। হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি ৫০ শয্যার ডায়ালাইসিস কেন্দ্র থাকবে। আট বিভাগে যে বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে, সেখানে প্রতিটি হাসপাতালে ৭০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টার থাকবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.