১০ ফেব্রুয়ারি। জেদ্দা থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামে সৌদি এয়ারলাইন্সের ‘এসভি-৮০২’ উড়োজাহাজটি। ‘আউট পাস (বিশেষ ভ্রমণ অনুমতি)’ নিয়ে সেই ফ্লাইটে চেপে ঢাকায় পা রাখে সাঈদ হোসাইন ও ইসমাইল নামে দুই রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে ছিল না পাসপোর্ট, ভিসা কিংবা নাগরিকত্ব সনদ। বাংলাদেশে ঢুকেই তারা ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে দু’জনকে পাঠানো হয় বিমানবন্দর থানা পুলিশের কাছে। শেষমেশ তাদের ঠিকানা হয় উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
সমকালের তথ্য অনুসন্ধান বলছে, এ বছরের প্রথম দুই মাসে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে সাঈদ ও ইসমাইলের মতো সাত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর আগে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ১৬ রোহিঙ্গা এই প্রক্রিয়ায় দেশে ঢোকে। একই সময়ে জালিয়াতি করে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে ধরা পড়ে ১২ রোহিঙ্গা। সব ঘটনায় জিডি হয়েছে থানায়। শুধু শাহজালাল নয়, চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়েও ঢুকছে কয়েকজন রোহিঙ্গা। নতুন করে একজন রোহিঙ্গাকেও আর আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে অনড় বাংলাদেশ। এই পটভূমিতে বিমানবন্দর দিয়ে রোহিঙ্গা প্রবেশ নতুন করে ভাবাচ্ছে। দেশের বিমানবন্দর হয়ে বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ঘটনা উদ্বেগজনক– বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, একজন রোহিঙ্গাকেও নতুনভাবে আশ্রয় দেওয়ার অবস্থা আমাদের নেই। বিমানবন্দর দিয়ে রোহিঙ্গা ঢোকার বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ও সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে আলোচনা করতে হবে।
ইমিগ্রেশন পুলিশ ও বিমানন্দর থানা পুলিশ সূত্র বলছে, সর্বশেষ ২০ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরব থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আরও দুই রোহিঙ্গা। তারা হলো– মুহাম্মদ হোসেন ও নূর আলম। সাধারণ ডায়েরির (জিডি) পর উখিয়ার জামতলী ক্যাম্পে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ বছরই কোনো কাগজপত্র ছাড়া শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে আরও যারা দেশে ঢুকেছে তারা হলো– নুরুল জামাল, মো. শাহ আলম, মোহাম্মদ তারেক কাদের মিয়া ও খায়রুল আমিন। গত ১৪ জানুয়ারি এয়ার এরাবিয়ার জি-৯৫১০ ফাইটে চেপে বাংলাদেশে এসেছিলেন খায়রুল।
মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে থাকছে। ২০১৭ সালের আগে থেকে লাখ চারেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনাচৌকিতে হামলার অজুহাত দেখিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এর পর কয়েক মাসে বাংলাদেশে ঢোকে আরও সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। জনবহুল আর সীমিত সম্পদের কারণে বাংলাদেশের জন্য বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাড়তি একটি চাপ। আবার নানা অজুহাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেও দেরি করছে মিয়ানমার। এর মধ্যে বিমানবন্দর দিয়ে রোহিঙ্গারা ঢুকলে তা চলমান সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তারাও বলছেন, দেশের বাইরে থেকে যারা বিমানবন্দর হয়ে ঢুকছে, তাদের অনেকে মিয়ানমার থেকে বিদেশে গিয়েছে। কেউ আবার কয়েক দশক ধরে বিদেশে ছিল। মিয়ানমারে না ফিরে তারা বাংলাদেশে ঢুকছে। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়স্বজন রয়েছে। তাই তারা এখানে ফিরছে।
এদিকে গত দুই মাসে বিমানবন্দর হয়ে বিদেশ যাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা আটক হয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় আটক হয় রবিউল আলম, ২৮ জানুয়ারি আটক হয় লায়লা বেগম, ২০ ফেব্রুয়ারি ধরা পড়ে শামীমা আক্তার। একইভাবে সৌদি আরব যাওয়ার পথে ১৪ ফেব্রুয়ারি আটক হয় আজিম উল্লাহ। তারা সবাই কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম বলেন, বিদেশ থেকে আসা রোহিঙ্গাদের প্রায়ই ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদের কাছে দেয়। এর পর তাদের পুলিশ হেফাজতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। একেকজনকে সেখানে পাঠাতে খরচ হয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা।
পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিদেশফেরত এসব রোহিঙ্গাকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিপাকে পড়ে। জিডির পর প্রত্যেককে পুলিশ হেফাজতে ক্যাম্পে পাঠাতে হয়। আবার নারী রোহিঙ্গা হলে তার সঙ্গে নারী পুলিশ সদস্য রাখতে হয়। ঢাকা থেকে দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের টেকনাফে পাঠানো ব্যয়বহুল। আবার পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত কাজের বাইরে সেখানে নিয়োজিত করতে হয়।
কক্সবাজার পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বিমানবন্দর হয়ে যেসব রোহিঙ্গা আসছেন, তাদের ক্যাম্পে আনার পর রেজিস্ট্রেশন করানো হয়। এর পর যে ব্লকে তাদের আত্মীয়স্বজন থাকেন, সেই ব্লকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তবে কেউ অপরাধে জড়িয়ে দেশ ছাড়লে বা বিদেশ থেকে ফেরত এলে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে আসাদুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা আটক হয়। সে একাধিক মামলার আসামি ছিল।
এ ব্যাপারে বিমানবন্দর থানার ওসি আজিজুল হক মিঞা বলেন, শুধু উড়োজাহাজে আসার টিকিটের অংশ নিয়ে মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গারা আউট পাসে বাংলাদেশে ঢুকছে। তাদের কাছে কোনো দেশের পাসপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদে বিদেশফেরত রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, কেউ কেউ ১৫ থেকে ২০ বছর বা তারও বেশি সময় আগে মিয়ানমার থেকে নানা উপায়ে সৌদি আরব কিংবা মালয়েশিয়া গেছে। এখন কারও কারও স্বজন কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছে। তাই তারা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরছে। কারও কারও দাবি, বিদেশে গিয়ে তারা আগের পাসপোর্ট স্বেচ্ছায় নষ্ট করে ফেলেছে। এর পর ওইসব দেশে নিজেদের শরণার্থী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করে।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানার ওসি আবু জাহেদ মো. নাজমুন নুর বলেন, গত তিন মাসে বিদেশ থেকে আসা চার রোহিঙ্গাকে ইমিগ্রেশন থেকে আমাদের কাছে দেওয়া হয়। এর পর তাদের কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ক্যাম্পের বাইরে কোনো জায়গায় রোহিঙ্গাদের আটক করা হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কোনো মামলা না থাকলে সাধারণত তাদের ক্যাম্পে রাখা হয়। আর মামলা থাকলে কারাগারে পাঠানো হয়।
ইমিগ্রেশন পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, কোনো কোনো রোহিঙ্গা সাগরপথে বা অন্য অবৈধ উপায়ে মালয়েশিয়া বা সৌদি আরব গিয়েছেন। কেউ আবার জালিয়াতি করে অন্যের পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। কাছাকাছি চেহারার অন্যের ছবি তারা ব্যবহার করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অবৈধ উপায়ে পালিয়ে বিদেশে যায়– এমন কেউ বাংলাদেশের বিমানবন্দরে এলে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় অনেক আগে থেকে রোহিঙ্গারা বাস করছে। বিশেষ করে সৌদি আরবে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিতে এক ধরনের চাপ রয়েছে। সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কতজন পাসপোর্ট পাবে, তা নির্ধারণে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ সম্প্রতি বৈঠক করে। সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী নাসের বিন আবদুল আজিজ আল দাউদের বাংলাদেশ সফরকালে রোহিঙ্গার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সময় সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে তিন লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। সৌদি আরবে ষাট-সত্তরের দশকেও রোহিঙ্গারা গেছে। তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে যায়। তিন প্রজন্ম ধরে যেসব রোহিঙ্গা সৌদি আরবে আছে, তাদের পাসপোর্টের ব্যাপারে বাংলাদেশ ভাবছে না। যারা বিশেষ বিবেচনায় গিয়েছিল, তাদের চিহ্নিত করে পাসপোর্ট নবায়ন করার কথা ভাবছে বাংলাদেশ।
সাহাদাত হোসেন পরশ