জুরাছড়িতে ১২৬ফুট বুদ্ধমূর্তির দানোৎসবে যা ঘটেছে

0
140
জুরাছড়ি সুবলং শাখা বনবিহারে ১২৬ফুট বুদ্ধমুর্তির উদ্বোধন।

দক্ষিণ এশিয়ায় আয়তনে সর্ববৃহৎ ১২৬ ফুট দীর্ঘ বুদ্ধমুর্তিটি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় জুরাছড়ি উপজেলায় সুবলং শাখা বনবিহারে নির্মাণ ও উদ্বোধন করে সর্বসাধারণে জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। গত ১৬, ১৭, ১৮ নভেম্বর ২০২২খ্রিঃ তিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে এটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

এ অনুষ্ঠানে বনভন্তের শিষ্যসংঘের মধ্যে প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির, ভৃগু মহাস্থবির, বুদ্ধশ্রী মহাস্থবির, সৌরজগৎ মহাস্থবির, বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবির, দেবানন্দ মহাস্থবির, প্রন্থক মহাস্থবিরসহ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘ উপস্থিত রয়েছে।

এর প্রকৃত নির্মাণ ব্যয় প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। যদিও অনুষ্ঠান চলাকালিন ও সাক্ষাৎকারে ভান্তেরা এর ব্যয় সাড়ে চার কোটি টাকা বলে ঘোষণা দিয়েছেন। স্থানীয় জনগণের শ্রমে নির্মাণ না হলে তার ব্যয় আরো তিনগুন হতো বলে বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রচারক চাকমা ও স্থায়ীয় জনগণের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়। তিনব্যাপী অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য বাজেট ধরা হয় ৪০(চল্লিশ) লাখ টাকা কিন্তু এ ব্যয় বেড়ে ৭০ লাখ অতিক্রান্ত করেছে বলে জানা যায়। এ অনুষ্ঠানের পরের দিন হতে শুরু হয়েছে ৫০০ জন গণশ্রমণ কার্যক্রম। এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন থাইল্যান্ড হতে আগত ধম্মাকায়া ফাউন্ডেশনের ভিক্ষসংঘ ও উপাসক উপাসিকাবৃন্দ।

এই বুদ্ধমুর্তিটির উদ্বোধনী ও জীবদানের তিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রায় দেড় লক্ষাধিক পূণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর সমাগম ঘটেছে জুরাছড়ির সুবলং শাখা বনবিহারে। জীবদানকালে মঙ্গল শোভা যাত্রায় দুইশতাধিক ভিক্ষুসংঘ ও পাঁচ হাজারের অধিক পূণ্যার্থী অংশ করে এক মনোরম পরিবেশ ও সৌন্দর্যে ভরে উঠে নবনির্মিত বুদ্ধমূর্তির চর্তুপার্শ্বে ।

১২৬ফুট বুদ্ধমুর্তিটির জীবদান অনুষ্ঠানের ছবি

শুভ উদ্বোধনী ও জীবদান অনুষ্ঠানে ১২৬ বুদ্ধমুর্তিটির অভিমুখে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি পরিচালনা করেন জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবির ভন্তে। তাঁর পিছনে পতাকাবাহি দল, ব্যান্ডদল, সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভন্তে শিষ্যসংঘ ও থাইল্যান্ড হতে আগত ভিক্ষসংঘসহ দুই শতাধিক ভিক্ষসংঘ, সাদা পোশাকদারি দল, পিনোন হাদি পোশাকের দল ও পরে দুরদুরান্ত হতে আগত সাধারণ দায়ক দায়িকাবৃন্দ সবাই বুদ্ধের জন্য ফুল হাতে এ শোভা যাত্রায় অংশ গ্রহন করেন। সুত্রপাতের মধ্যমে বুদ্ধের জীবদান সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় পর্বে ১২৬ফুট বুদ্ধমুর্তিকে চীবর পরিধান করানো হয়। বুদ্ধকে জীবদানের সময় সকল পূণ্যার্থীদের পূজাদান হতে সাময়িক বিরতির পর তিনদিন ধরে ফুল দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করা হয় এবং সন্ধ্যায় হাজার বাতি প্রজ্জলন ও প্রতিদিন পাঁচশত করে ফানুচবাতি উড়ানো হয়। নির্মাণরতি নামে মঞ্চে স্থায়ীয় ও নানান জায়গা হতে আগত শিল্পীদের দিয়ে সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের পরিবেশনা চলে প্রতিদিন।

চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়

নির্মাণ শৈলী ও পরিকল্পনায় এটি পার্বত্য অঞ্চলের বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে নতুন রূপে তুলে ধরবে এমনটা আশাবাদ ব্যক্ত করেন স্থানীয় জনগণ ও বিহারের অবস্থানরত ভিক্ষুসংঘ। ১২৬ ফুট বুদ্ধমূর্তিটি নির্মাণের অন্যতম উদ্যোক্তা জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবির ভন্তে এই প্রসংগে বলেন, সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভন্তে জুরাছড়ি এসে ধর্ম প্রচার করেছেন এবং সাধারণ জনগণকে জ্ঞানদান, ধর্মদান, অভয়দান করেছেন এই চারি স্মৃতি রক্ষার্থে বনভন্তের স্মরণে এই বুদ্ধমুর্তি নির্মাণ করা হয়েছে। রাঙ্গামাটির স্থাপত্য শিল্পী অচিংপ্রু মারমা এবং ইঞ্জিনিয়ার তৃপ্তিসংকর চাকমা বুদ্ধমুর্তি নির্মাণে এই দুইজন ব্যক্তি খুবই গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা

এ বুদ্ধমুর্তিটি নির্মাণের প্রস্তাবনা ও উদ্যোগ গ্রহন করেছেন জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবির, বুদ্ধশ্রী মহাস্থবির, জিনপ্রিয় মহাস্থবির, আর্য্যনন্দ মহাস্থবির ও প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবিরসহ প্রমুখ। অপর দিকে এই বনবিহার স্থাপনার জন্য জায়গা দান ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সাধারণ সম্পাদক প্রচারক চাকমা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সদস্য প্রবর্তক চাকমার পরিবারবর্গ বিশেষ অবদান রেখেছেন। আর সর্বপরি প্রশংসার দাবিদান ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সবার বিশ্বস্ত বা আস্থার প্রতীক ধল কুমার চাকমা, অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ও সাবেক বিমাণবাহিনীর সদস্য। তিনি অর্থ সংগ্রহ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন এবং সবাইকে মতাদর্শে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছে।

রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

অনেক দায়ক দায়িকা লক্ষাধিক অর্থদান করেছেন, মাসিক নির্দিষ্ট অর্থদান এবং প্যাকেজ দান দিয়েছেন। শলক এলাকা হতে রাজবন বিহারে বা শাখা বনবিহারে অবস্থারত ৭৫জন ভিক্ষু বিশেষ অবদান রেখেছেন। তদমধ্যে ১৫জন মহাস্থবিরগণ ২০,০০০/-টাকা(বিশ হাজার) করে এবং স্থবিরগণ ১০,০০০/-টাকা (দশ হাজার) করে এককালিন অর্থদান করেছেন। এছাড়াও খাগড়াছড়িবাসি, রাঙ্গামাটিবাসিসহ দেশ বিদেশে অবস্থানরত বহু পূণ্যার্থী, সাধারণজনগণ অর্থদান করেছেন। এটি অনন্য দৃষ্টান্ত যে সরকারের কোন অর্থ সহযোগিতা ছাড়া এত বড় স্থাপনাটি সুসম্পন্ন হয়েছে।

রাঙ্গামাটি পুলিশ ‍সুপার জনাব মীর আবু তৌহিদ

২য় দিনে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকার এমপি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী সকালের পর্বে অনুষ্ঠানে যোগদান করেন এবং বক্তব্য প্রদান করেন। বিকালের পর্বে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় অনুষ্ঠানে যোগদান করেন এবং বক্তব্য প্রদান করেছেন।

১ম পর্বে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন সুবলং বনবিহার পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে প্রবর্তক চাকমা, সাবেক জুরাছড়ির উপজেলা চেয়ারম্যান ও বর্তমানে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাপরিষদ সদস্য। যারা যারা বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন, অর্থ ও শ্রম দিয়েছেন এবং অনুষ্ঠানে নানাভাবে সহযোগিতা প্রদান করেছেন সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

জনাব অংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, জুরাছড়ির মত এত দুর্গম এলাকায় এ রকম বুদ্ধমুর্তি নির্মাণ সবার কাছে, বৌদ্ধ সমাজের কাছে প্রশংসার যোগ্য আমি পক্ষ থেকে এবং জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাদেরকে সাধুবাদ জানাই। আজ বুদ্ধমুর্তিটি উৎসর্গের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজের প্রতীক ‍ও সম্পদে পরিণত হয়েছে। এই বুদ্ধমতি অনন্তকাল ধরে থাকবে। বুদ্ধমুর্তিটি উৎসর্গের মাধ্যমে বুদ্ধ শাসন চিরস্থায়ী হোক, বুদ্ধেবাণী, আদর্শ সমাজে বা বিশ্বে যত ছড়িয়ে পড়বে ততই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

জনাব দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, জুরাছড়ির মত যোগযোগ অসুবিধা দুর্গম এলাকায় হাজার হাজার মানুষ তিন ধরে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় আসতেছে বুদ্ধশাসন চীরস্থায়ী হওয়ার যে কামনা আমরা নিশ্চয়ই সফল হবো। এ ব্যাপারে সর্ব প্রথম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি পরম পূজানীয় বনভন্তেকে। উনার আগমনের পর থেকে বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে চেতনা জেগেছে মানুষের মনে, অনুরাগ জেগেছে তারা ধর্ম পালন করছে। সাড়ে চার কোটি টাকা দান অনুুদান দিয়ে এত কাজ সম্পাদন করা বিশাল কৃতিত্বের ব্যাপার।

বিকালে পর্বে বক্তব্যকালে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, আমরা সবাই খুশি, শ্রদ্ধেয় বনভন্তে থাকলে তিনিও আর্শিবাদ করতেন, শলকবাসিরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, এই বুদ্ধমুর্তিটি নির্মাণের ফলে তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলে। ধনে সম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে থাকতে পারবেন যদি প্রকৃতি পরিবেশ বন সংরক্ষণ করতে পারেন। না হয় বৃষ্টি হবে না, পানিও আসবে না, ফসলও ফলবে না। এটি বুদ্ধের বাণী সকল প্রাণি সুখী হোক। ১২৬ফুট বুদ্ধমুর্তি ও বিশ্বশান্তি প্যাগোডার মাধ্যমে বিশ্বের মাঝে পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধরা পরিচিতি লাভ করবে। তাই বিশ্বশান্তি নির্মাণের সকলে প্রতি সহযোগিতার আহবান জানান।

৩য় দিনের সমাপনি অনুুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকম ও তাঁর সহধর্মীনি রিপা চাকমা যোগদান করেন। নিখিল কুমার চাকমা অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন এবং মন্দির স্থাপনের জন্য দেড় কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলে তিনি চলতি অর্থ বছরে চল্লিশ লক্ষ টাকা অনুদানের ঘোষনা দেন। বাকি কাজ সমাপ্ত করারও আশ্বাস প্রদান করেন। জেলা প্রশাসক জনাব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ও পুলিশ ‍সুপার জনাব মীর আবু তৌহিদ অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন।

জনাব মিজানুর রহমান বলেন, আমি যতবারই আসি মনভরে যায়, এত নিরিবিলি, এত নিঃশব্দ, এত চমৎকার পরিবেশ।১২৬ফুট বুদ্ধমুর্তির মাধ্যমে বুদ্ধের শান্তিরবাণী চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে, সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে উঠবে, আমরা সম্প্রীতি নিয়েই বাংলাদেশে বসবাস করতে চাই।

জনাব জনাব মীর আবু তৌহিদ বলেন, প্রত্যক ধর্মই মানুষকে শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়। এ জেলায় রয়েছে বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে সংমিশ্রণে আমরা পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করছি। আমরা প্রত্যেকেই যদি অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, এভাবে আমাদের সামাজি সম্পর্ক যদি বিনির্মাণ করি তাহলে সুখী সমৃদ্ধ জীবন নিয়ে এখানে বসবাস করতে পারি। আমি খুশী জুরাছড়ির এই বুদ্ধমুর্তিটি দেশে ও দেশের বাইরে মানুষের কাছে প্রতীকি হিসেবে রাঙ্গামাটিকে পরিচিত করে তোলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.