ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন; প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যে গত বেশ কয়েকমাস ধরে অসন্তোষ জানিয়ে আসছিল এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিন ঘোষণা করতে টালবাহানা করছেন বলে অভিযোগ তুলে তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছিল অন্যান্য আরও কয়েকটি দল। এ অবস্থায় পবিত্র ঈদুল আজহার আগের দিন শুক্রবার (৬ জুন) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বহু কাঙিক্ষত সেই সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর নির্বাচন কমিশন (ইসি) উপযুক্ত সময়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।
প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার পর থেকেই চঞ্চল হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। একেক রকম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন একেক দলের নেতারা।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আগের তুলনায় অনেকটা সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করলেও অসন্তোষ কাটেনি বিএনপির। তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের কথা বলেছে। সেগুলো আমলে না নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অনুপযোগী বর্ষা, পরীক্ষা ও রোজার সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। সার্বিক বিবেচনায় জানুয়ারির মধ্যেও যদি নির্বাচন হতে পারত এবং সেটিও গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা এটা আমলে নেন নাই।
তিনি বলেন, বাকি প্রতিক্রিয়া দল ও যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জানাবো।
বন্দরের মতো জাতীয় ইস্যু নিয়ে ম্যান্ডেটহীন সরকারের বক্তব্য দেওয়া উচিত কি না, সেই প্রশ্নও রেখেছেন বিএনপির সিনিয়র এ নেতা।
এপ্রিলে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সম্পূর্ণ উল্টো দিকে অবস্থান করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের দিন ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, এই ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে এবং ঘোষিত সময়ের মধ্যেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জাতি আশা প্রকাশ করছে। জাতির তীব্র আকাঙ্খার সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে এবং ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
তবে, বিএনপির সুরে সুর মেলাচ্ছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার শুক্রবারের (৬ জুন) বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলো হতাশ হবে। রাজনৈতিক দলের দাবিগুলো তিনি তেমন করে আমলে নেন নাই।
তিনি বলেন, আবহাওয়া বিবেচনায় এপ্রিল মাস ভোটের জন্য উপযুক্ত নয়। রোজার আগে অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ভোটের জন্য সঠিক সময়।
সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে বোঝাতে পারেন নাই কেন নির্বাচন ডিসেম্বরে নয়। সর্বোচ্চ জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি; এরপর নির্বাচন যাওয়া ঠিক নয়। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের দেওয়ার বিরুদ্ধে যারা কথা বলছে, প্রধান উপদেষ্টা তাদের প্রতিহত করার কথা বলেছেন। করিডোর প্রশ্ন তিনি অস্বীকার করলেন। এক ধরনের প্যাসেজ আলোচনা ছিলো, তার থেকে তিনি বেড়িয়ে গেলেন। সরকার রাজনৈতিক দলকে দূরে রেখে কাজ করছে।
প্রধান উপদেষ্টার এই ভাষণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কট নতুন মাত্রা পেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, এটা একটা অগ্রগতি বলে মনে হলেও এখানে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। কারণ, দেশের মানুষ ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। আমরাও তা-ই চাই।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কেন কালক্ষেপণ করে এপ্রিলে নির্বাচনের কথা বলছেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে তিনি কী কী কাজ করতে চান তা-ও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সব মিলিয়ে আরও অধিক সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকলে জনজীবনের সঙ্কটেই ঘনীভূত হবে বলে আমরা মনে করছি।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা আশা করব নির্বাচন কমিশনকে এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করার কথা বলা হবে এবং তার আগে অবাধ গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবেন। এটা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। এটি আমাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। এ বিষয়ে আমাদের দলের প্রেসিডিয়াম, বাম গণতান্ত্রিক জোট ও গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কথা বলে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।
হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মহিউদ্দিন রব্বানী বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে দিন ঘোষণা করেছেন তা সঠিক নাকি ভুল এই বিবেচনা দেশবাসী করবেন। তবে একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা মনে করি, এপ্রিল থেকে দুই-এক মাস আগেও নির্বাচন হতে পারে। তবে সেটি প্রধান উপদেষ্টা পুনরায় বিবেচনা করবেন বলে আমরা আশা করি।
এদিকে এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণায় জামায়াতের মতো সন্তোষ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের দিনক্ষণের ঘোষণা নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। তবে, তার আগে জুলাই সনদ, দৃশ্যমান বিচার এবং সংস্কার হতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরণের অস্থিরতা প্রশমিত হয়েছে। একই সঙ্গে বন্দর, মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করে উদ্বেগ দূর করায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রসংস্কারই ছিলো জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান লক্ষ্য এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম কর্তব্য। সেই সংস্কার কাজের যে অগ্রগতির বিবরণ তিনি তুলে ধরেছেন তাতে আমরা আশান্বিত হয়েছি। আমরা প্রত্যাশা করি তিনি ও তার সরকার সকল বাঁধা উপেক্ষা করে সংস্কারের কাজ শেষ করবেন। বিচারের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতির বিবরণ দিয়েছেন তা জাতিকে আশ্বস্ত করেছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন; দেশ যুদ্ধাবস্থায় আছে। নানামুখী চক্রান্ত ও অপপ্রচার দেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরছে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা দেশের স্বার্থেই আবশ্যক। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কুয়াশা রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলো তা আজকে কেটে গেছে। ফলে সংস্কার ও বিচারের কাজে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার যে আহবান তিনি করেছেন তাতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরাবরের মতো সাড়া দেবে।
অন্যদিকে এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, এপ্রিল মাসে আমাদের আবহাওয়াজনিত একটা থ্রেট আছে। প্রধান উপদেষ্টা বিচার, সংস্কার, নির্বাচনের যে রূপরেখা দিয়েছেন, তার ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। এখানে ষড়যন্ত্র বা চাপ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে এপ্রিলের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের দিন ঘোষণায় স্বাগত জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকিও। তবে নির্বাচনের সময়টা সমর্থন করছেন না তিনি।
সাকি প্রধান উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত সময় নির্ধারণের আহ্বান জানান। এপ্রিল মাস নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে।