আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে কিস্তি পেতে বাংলাদেশ যে প্রথমবারের মতো হোঁচট খেয়েছে, এ দফায় তা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে। এ জন্য ভর্তুকি কমানো, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের পর ছেড়ে দেওয়ার মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশকে।
শর্ত পূরণে বাংলাদেশ ও আইএমএফ যদি নিজ নিজ অবস্থানে অনমনীয় থাকে, তাহলে আর কোনো কিস্তি না–ও মিলতে পারে। তখন বাংলাদেশের জন্য দেখা যাবে নতুন জটিলতা। অর্থাৎ অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোও তখন বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে রক্ষণশীল হয়ে যেতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজেও এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি থেকে দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পেতে বাংলাদেশের সামনে মোটাদাগে তিনটি বাধা রয়েছে। এসব বাধা অতিক্রম করতে না পারলে আইএমএফের কিস্তি পাওয়া কঠিন হবে। এগুলো হলো মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব আদায় ও এনবিআরের রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব প্রশাসনকে আলাদা করা।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যদিও আইএমএফকে জানানো হয়েছে, এসব শর্ত বাস্তবায়ন করা হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব প্রশাসনকে আলাদা করার পদক্ষেপ ছাড়া বাকি দুটির বিষয়ে তেমন অগ্রগতি নেই।
আগামী জুনের মধ্যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি এক প্রাক্-বাজেট আলোচনায় বলেন, ‘তা এখন বলব না। কারণ, মূল্যস্ফীতি আরও কত দিন থাকে, দেখতে হবে। হঠাৎ বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে গেলে তো বিপদ বাড়বে।’
বর্তমানে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হচ্ছে। যার কারণে হঠাৎ ডলারের দাম খুব বেশি বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ পদ্ধতিতে ডলারের দাম আপাতত ১২২ টাকায় স্থিতিশীল।
আশা দুই কিস্তি একসঙ্গে পাওয়ার
২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ঋণ কর্মসূচি চালু হওয়ার পর আইএমএফ থেকে তিন কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। বিপত্তি দেখা দেয় চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে। যদিও সরকার যদিও আশা করছে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পাওয়া যাবে আগামী জুনে।
সম্প্রতি অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের সঙ্গে এক প্রাক্-বাজেট আলোচনায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাজেট সহায়তার জন্যই আইএমএফ ঋণ লাগবে। এ কারণেই বাংলাদেশ সরকার ও আইএমএফ যৌথভাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের বিষয়ে সম্মত হয়।
৬ এপ্রিল থেকে বৈঠক শুরু
এদিকে ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্ত পালনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় আইএমএফের একটি দল আগামী ৫ এপ্রিল ঢাকায় আসছে। দলটি ৬ এপ্রিল থেকে টানা দুই সপ্তাহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ সফরে আইএমএফের দলটির সঙ্গে অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠক শেষে ১৭ এপ্রিল প্রেস ব্রিফিং করবে সফররত আইএমএফের দল। দলটি প্রথম দিন ৬ এপ্রিল এবং শেষ দিন ১৭ এপ্রিল বৈঠক করবে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মোটাদাগে তিন বাধা না ছুটলে আইএমএফের ঋণের কিস্তির ভবিষ্যৎ কী হবে বলা যাচ্ছে না। আইএমএফ চায় বাংলাদেশ বিদ্যমান ক্রলিং পেগ থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাবে। অর্থ উপদেষ্টা বলছেন বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা হতে পারে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, প্রবাসী আয় রেকর্ড হয়েছে। রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও ভালো। এখন যদি বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া না হয়, তবে কখন দেওয়া হবে?’
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। অন্তত ৫৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করতে হবে, কিন্তু রাজস্ব আদায় বাড়াতে উদ্যোগ কম। তবে আইএমএফের শর্ত মানতে এনবিআরের নীতি ও প্রশাসন বিভাগ আলাদা হতে যাচ্ছে, তা বলা যায়। এ ছাড়া কর অব্যাহতি কমানো হবে বলে বলা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা কিন্তু কর অব্যাহতির বিরুদ্ধে এককাট্টা, এটাও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।
ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবে আইএমএফ বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বলতে পারে এবং এটিকে সংস্থাটির বাড়াবাড়ি বলেও মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে ভরসা পাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়ে যেতে পারে। তাই সরকারের ভেবেচিন্তেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর আইএমএফেরও উচিত বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝা। আমি মনে করি, উভয় পক্ষকে ছাড় দিয়ে হলেও ঋণ কর্মসূচিটি বজায় রাখা দরকার।’
ফখরুল ইসলাম
ঢাকা