পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার বোলাদিয়া ইউনিয়নে গত জুলাই মাসে এডিস মশার লার্ভা জরিপ হয়। সেখানে ১০টি বাড়ির মধ্যে ৭টিতেই এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে।
এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানে সেখানে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিশ্চিতভাবে বেড়ে যায়। বোলাদিয়ার গ্রামে বিআইয়ের পরিমাণ হলো ৮০।
পিরোজপুরের সিভিল সার্জন মো. হাসনাত ইউসুফ জাকী বলছিলেন, ‘এবার যত এডিস মশা পাওয়া গেছে, গতবার তার চার ভাগের এক ভাগ ছিল।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামের যেসব রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন, তাঁদের শহর থেকে আসার ইতিহাস থাকে।
সিভিল সার্জন হাসনাত ইউসুফ জাকী বলছিলেন, নেছারাবাদের ব্যাপারটা একেবারে উল্টো। এখানে স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী অনেক বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার ‘ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ দেশের ১৫ জেলায় লার্ভা জরিপ করেছে। সেখানে দেখা গেছে এডিস মশা প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলে মশার লার্ভার ঘনত্ব কিছু ক্ষেত্রে শহরের চেয়েও বেশি। এডিস মশার মধ্যে ইজিপ্টাই বেশি মাত্রায় ডেঙ্গু ছড়ায়। এখন প্রত্যন্ত এলাকায় এর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে।
এভাবে এডিস মশা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে যাওয়া বা লার্ভার এমন ঘনত্বে বিপদ দেখছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তাঁদের কথা, সামনে সংকটময় সময় আসছে।
ঢাকার বাইরের এডিস-চিত্র: ২০১৯-২৩
এবার এখন পর্যন্ত ঢাকা নগরের চেয়ে বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। এমনটি এর আগে আর কখনোই হয়নি।
এবার ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রকোপ শুরু হওয়ার পর যেসব স্থানে জরিপ হয়, এর মধ্যে আছে যশোর পৌরসভা। এ বছর এ পৌরসভার বিআই হলো ৮০। বাংলাদেশে এবারের আগে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল ২০১৯ সালে। তখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করা জরিপ অনুযায়ী, পৌরসভার গড় বিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২২।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ২০১৯ সালে গড় বিআই ছিল ১৬। গত বছর তা ছিল ১৬। এবার হয়েছে ৪৬।
ঢাকার বাইরের শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও বিআইয়ের বা লার্ভার ঘনত্ব অনেক বেশি দেখা গেছে এ বছর। পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার আঙ্গারিয়া ইউনিয়নে এবার বিআই ১০০।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ মো. খলিলুর রহমান দীর্ঘ সময় ধরে মশার লার্ভা জরিপের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এবারও অধিদপ্তরের একাধিক জরিপে ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘এবার এডিসের লার্ভার যে ঘনত্ব দেখেছি, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তা একেবারে নতুন। এটা মারাত্মক হারে বেড়েছে।’
লার্ভার ঘনত্ব বেশি হওয়ার ফল কী
এডিস মশার ঘনত্ব গ্রামগঞ্জে বেড়ে যাওয়ার কারণে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবীরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘এবার এডিস যেভাবে গ্রামে ছড়িয়েছে, তাতে আর এ মশা এ দেশ থেকে তাড়ানো যাবে বলে মনে হয় না। এবার যেসব গ্রামে পাওয়া গেল, ভবিষ্যতে আশপাশের নতুন নতুন গ্রামে পাওয়া যেতে পারে।
জ্যামিতিক হারে বাড়তে পারে মশার সংখ্যা।’
ডেঙ্গুর বড় বিস্তার সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর হয়। বাংলাদেশে বড় বিস্তার হয়েছিল ২০১৯ সালে, এরপর এবার হলো। কিন্তু এবার যে হারে এডিস ছড়িয়েছে, তাতে তিন থেকে পাঁচ বছরের এই ধারা ঠিক থাকবে না বলে মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার কুইসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও কীটতত্ত্ববিদ হাসান মোহাম্মদ আল-আমিন। তিনি বলছিলেন, ‘আগামী বছর ডেঙ্গু আরও বাড়বে, এটা ধরে নেওয়া যায়।’
ইজিপ্টাই বাড়ছে
এডিস মশার ২৬ প্রজাতির মধ্যে ইজিপ্টাই ও অ্যালবোপিকটাস ডেঙ্গু ছড়ায়। ইজিপ্টাইয়ের প্রাধান্য নগরে, গ্রামে অ্যালবোপিকটাসের।
আগেও রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং দু-একটি জেলায় বেশি ছিল ইজিপ্টাই। অন্য এলাকায় ছিল অ্যালবোপিকটাসের প্রভাব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে ইজিপ্টাইয়ের দাপট।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২০১৭ সালে মশার জরিপ করেন গবেষক হাসান মোহাম্মদ আল-আমিন। তিনি বলেন, ‘সে বছর রাজশাহীতে ইজিপ্টাইয়ের পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি পাইনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এবারের জরিপে দেখা গেছে, এবার তা হয়েছে ২০ শতাংশ। পার্বত্য এলাকায় সেবার ৫০ শতাংশ পেয়েছিলাম। এবার রাঙামাটিতে তা হয়েছে ৬৫ শতাংশ।’
অধ্যাপক কবিরুল বাশার সাভারের ইসলামনগর, গোপালনগর এবং দোহারের একাধিক গ্রামে জরিপে এ বছর ইজিপ্টাই মশা পেয়েছেন। তিনি বলছিলেন, ‘আগে এসব গ্রামে কোনো দিন ইজিপ্টাই দেখিনি।’
স্বাস্থ্যঝুঁকি চরমে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গ্রাম এলাকার জরিপে, অনেক স্থানে প্লাস্টিকের পাত্রে এডিসের মশার লার্ভা মিলেছে বলে জানান মো. খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, গ্রামে এখন শহরের মতো কংক্রিটের দালনকোঠা বেড়েছে। প্লাস্টিকের নানা তৈজসপত্রসহ শহরের মানুষের ব্যবহার্য অনেক জিনিস গ্রামে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। এর পাশাপাশি আছে অটোরিকশার টায়ার।
গত ৩০ জুলাই থেকে টানা গতকাল রোববার পর্যন্ত ঢাকার চেয়ে বাইরে বেশি সংখ্যায় ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তবে ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও মৃত্যু বেশি। এর কারণ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমদের কথা, ঢাকার রোগীদের অনেকেই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ায় মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে গেছে।
ঢাকার এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটতে পারে বলেই আশঙ্কা জনস্বাস্থ্যবিদদের। এর কারণ প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘যে চিত্র আমরা ঢাকা মহানগরীতে দেখেছি, সেটা এখন চট্টগ্রাম ও বরিশাল ছাড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় দেখা যাচ্ছে। পুরো বাংলাদেশই এখন ডেঙ্গু ঝুঁকির এলাকা। এ বছরই ঢাকার বাইরে অনেকে একাধিক ধরনে আক্রান্ত হয়ে গেছেন।’
করণীয় কী
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এডিস নিয়ন্ত্রণে ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে কিছুটা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দেখা গেলেও গ্রামে তার কিছুই নেই। গ্রামাঞ্চলে ইজিপ্টাই বাড়লেও সেখানে অ্যালবোপিকটাসের মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। সেটাকে শনাক্ত করা জরুরি বলে মনে করেন কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান। জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমদও মনে করেন, এখন দেশজুড়ে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। তাই পরিকল্পনাও বিশদে হতে হবে। সারা বাংলাদেশকেই তার মধ্যে রাখতে হবে।
আরও ১৬ জনের মৃত্যু
দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে শনিবার ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ২১ রোগীর মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে ৬৩৪ জনের মৃত্যু হলো।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে ঢাকায় ৮ জন ও ঢাকার বাইরে ৮ জন মারা গেছেন। এ সময় ডেঙ্গু নিয়ে ২ হাজার ৬০৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৮৯২ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোয় ১ হাজার ৭১৬ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।