দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব–সন্ত্রাস ও শ্রমিক হত্যার দায়িত্ব এই অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে বলে দাবি জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। আজ বৃহস্পতিবার কমিটির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়।
কমিটির পক্ষে বিবৃতিটি দিয়েছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সামিনা লুৎফা, হারুন উর রশীদ, মাহা মির্জা, মাহতাব উদ্দীন আহমেদ ও মারজিয়া প্রভা।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বলেছে, মানুষের জীবনকে বিপন্ন করা, শ্রমিক হত্যা, আদিবাসী নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের প্রাণহানি, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরে জবরদস্তি প্রমাণ করে অন্তর্বর্তী সরকার জনস্বার্থে কোনো পরিবর্তনে আগ্রহী নয়। গণ-অভ্যুত্থানের পরের এক বছরেই অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারকে ফিরিয়ে এনেছে।
বিবৃতিতে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অনেক শ্রমজীবী মানুষের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। অথচ গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রথম বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে শ্রমিককে। সেই ধারাবাহিকতাতেই রাষ্ট্রীয় যৌথ বাহিনী ২ সেপ্টেম্বর শ্রমিক ছাঁটাই প্রতিবাদের ন্যায্য আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এভারগ্রিন কারখানার শ্রমিক হাবিব ইসলামকে হত্যা করেছে। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে এ শ্রমিক হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়হীনভাবে এই ঘটনাগুলো কেবল ঘটতে দেয়নি, জনগণের ন্যূনতম মানবাধিকারকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, আগের সরকারের মতোই শ্রমিকবিরোধী, নারীবিরোধী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাবিরোধী, অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা গ্রহণ করছে এই সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্লিপ্ততায় বা সমর্থনে দেশে ‘মবোক্রেসি’ চলছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, রংপুরের তারাগঞ্জে দুজন ভ্যানচালক রুপলাল দাস ও প্রদীপ দাসকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। রংপুরের গঙ্গাছড়ায় ধর্ম অবমাননার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা তৈরি করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, লুট ও আগুন দেওয়া হয়েছে। অথচ পুলিশ হামলাকারীকে না ধরে ফেসবুকের একজন নিছক পোস্টদাতাকে গ্রেপ্তার করে মব হামলার প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছে।
লালমনিরহাটে বৃদ্ধ নাপিত পরেশ চন্দ্র শীল ও তাঁর ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে মিথ্যা ধর্ম অবমাননার অপবাদে পেটানো হয়েছে এবং পুলিশ সেই নির্যাতনকারীকে গ্রেপ্তার না করে পরেশ ও বিষ্ণুকেই গ্রেপ্তার করে মবের বৈধতা দিয়েছে।
ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক আলোচনাসভায় মব–সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। পরে পুলিশ সন্ত্রাসীদের না ধরে সেই সভার আলোচক মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। পরে সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় তাঁদেরই কারাগারে পাঠিয়েছে। মব আক্রমণের একাধিক ঘটনা যখন জনগণের জানমালকে প্রতি মুহূর্তে বিপন্ন করে দিয়েছে, তখন প্রধান উপদেষ্টার মুখপাত্র মবকে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন এবং জনগণের সঙ্গে তামাশা করেছেন।
গণহত্যার বিচারের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণহত্যার বিচার বৈশ্বিক মানদণ্ড মেনে না করে উল্টো গণহারে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। তারা ফ্যাসিস্ট পদ্ধতির এতটুকু বদল না করে ফ্যাসিবাদবিরোধিতার বাগাড়ম্বর করছে। ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জেরে লীগ-ট্যাগ দিয়ে মামলা করা ও বিচারহীনভাবে জেলে আটকে রাখাকে স্বাভাবিক করেছে এখনকার বিচারব্যবস্থা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর জামিন অধিকারকে সংরক্ষণ করা হচ্ছে অথচ বম নাগরিকেরা কারাগারে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁদের জামিনের অধিকার দেখছেন না আদালত। এভাবেই প্রশাসনিক ও বিচারিক ব্যবস্থার গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষা ও ফ্যাসিস্ট কাঠামোর বদৌলতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরের এক বছরে হাসিনার সরকারকে ফিরিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার বিষয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ওপর সংগঠিত রক্তক্ষয়ী হামলা এবং হামলা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা বিস্ময়কর। যৌথবাহিনী কেন স্থানীয় মব ও হামলা সামলাতে পারছে না, তা আশ্চর্য বিষয়।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে মব–সন্ত্রাসসহ জনস্বার্থবিরোধী তৎপরতা বন্ধের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে শ্রমিক হত্যা, গণধর্ষণসহ নারীবিদ্বেষী তৎপরতা, লুটপাট, হামলা ও সহিংসতায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ও শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ, নির্যাতন বন্ধ, অন্যায়ভাবে ছাঁটাই প্রত্যাহার এবং নিহত শ্রমিকের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়।