আমার সৌভাগ্য যে আমি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমার গবেষণা কাজের মেন্টর বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পেয়েছিলাম। সবার এমন সুযোগ হয় না। ভীষণ একরোখা মানুষ। কোনো কিছু যদি মনে করেন যে করবেন; তিনি করেই ছাড়বেন। ওনাকে যদি বোঝানো যায়– এ কাজটা করলে দেশের উপকার হবে, মানুষের উপকার হবে, তিনি যদি একমত হন, তখন সেটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর তখন সে কী উৎসাহ। নতুন কাজের সামনে তিনি আর প্রবীণ নন, নবীনদের চেয়েও তাজা ও চাঙ্গা তখন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের এক নির্ভীক যোদ্ধা স্বাধীনতার পরেও যেভাবে মানুষের জন্য কাজ করেছেন, তা অবাক করে দেয়। এক জীবনে তিনি বহু জীবনের সমান অবদান রেখে গেছেন; এখনও করে যাচ্ছেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমরা ‘স্যার’ বলে ডাকি। মন থেকেই আসে এই ডাক। তিনি নেতাও বটে, শিক্ষকও বটে। তাঁর সম্পর্কে তো জানতামই। গণস্বাস্থ্যের শুরুর দিকের কঠিন সময়েও খবর পেতাম।
আমি সাভারে আসি ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে। আমার কাজের জায়গা আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্যবধান মাইলখানেক। তাই মাঝে মধ্যেই সেখানে যাওয়া চলত। তখন গণস্বাস্থ্যে অনেক নারীকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। আমাদের মতো দেশে সেটা এক তাক লাগানো ব্যাপার। অভিনব ঘটনা।
আমি গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে কাজের চিন্তা করি ১৯৯৩ সালের দিকে। পিএইচডি করে বিদেশ থেকে ফিরে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম, তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাই। কিন্তু আমার তখনকার প্রতিষ্ঠান আমাকে ছাড়ল না। তখন ভ্যাকসিন রিসার্চ ল্যাবরেটরি বলে গণস্বাস্থ্যের একটা প্রকল্প ছিল। গণস্বাস্থ্যে যোগ দিতে না পারলেও আমি এ গবেষণাগার থেকে সাহায্য নিয়ে কাজ করেছি।
এরপর অনেক দিন দেখা নেই। সিঙ্গাপুর চলে গেলাম ২০০২ সালের দিকে। মাঝেমধ্যে আসতাম। এর মধ্যে আমার কিছু প্রডাক্ট কীভাবে বাংলাদেশে চালু করা যায়, তা নিয়ে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা আমাকে গণস্বাস্থ্যের কথাই বলল, যেহেতু তাদের নিজস্ব অবকাঠামো আছে, গবেষণাগার আছে, ওষুধ উৎপাদনের বিরাট অভিজ্ঞতা আছে। তো এই প্রস্তাব নিয়ে আলাপের একটা পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম।
এর একটা পটভূমি আছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে আমি একটা চিঠি পেলাম। তখন আমি সিঙ্গাপুরে কর্মরত। সে সময় করোনাভাইরাস কেবল ছড়াতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে তখন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল তাদের গোলটেবিল বৈঠকে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। সেটা ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালের ঘটনা। আমি তো ২০০২ সালেও করোনা নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। তাঁরা তা জানতেন, তাই আমাকেও ডাকেন।
এ উপলক্ষে দেশে এলেও আমি স্যারের সঙ্গে কাজের আগ্রহ জানালাম। এদিকে বিমান চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সিঙ্গাপুরে ফিরে যেতেও পারছিলাম না। তো স্যার আমাকে বললেন, কেন আমি করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করতে চাই। বললাম, এই রোগ ভয়াবহ আকার নেবে। চীনা নববর্ষ উৎসব থেকে এটা ছড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীতে তিনটা বড় জমায়েত হয়– চীনা নববর্ষ, ভারতের কুম্ভ মেলা আর মক্কার হজ। সুতরাং আশঙ্কা গভীর। তখন আমি তাঁকে পাঁচটি প্রস্তাব দিলাম:
প্রথমত, অ্যান্টিজেন র্যাপিড টেস্ট করতে হবে। তখন করোনাকে প্যানডেমিক ঘোষণা করা হয়েছে। তার মানে সবারই এই রোগ হতে পারে। পিসিআরের মতো সফিস্টিকেটেড টেস্ট সবাইকে করানো সম্ভব হবে না। তাই অ্যান্টিজেন কিট বানাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মাল্টিলেয়ার কটন মাস্ক জরুরি। এর গুণাগুণ বলার পরদিনই তিনি এর উৎপাদন শুরু করে দেন।
তৃতীয়ত, ভিটামিন সি ও জিংক খাওয়াতে হবে মানুষকে।
চতুর্থত, করোনা রোগীর প্লাজমা সেল ব্যবহার করে নতুন রোগীর চিকিৎসা করা। তাই বললাম প্লাজমা ব্যাংক গড়ে তুলতে হবে।
পঞ্চমত, পিসিআর ল্যাব লাগবে রেফারেন্সিংয়ের জন্য, গবেষণার জন্য।
জাফরুল্লাহ স্যার একমত হলেন। আমরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তিনি বলেছিলেন, কোনো দিকে চিন্তা করবে না, পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে তোমরা কাজ করো। টাকার চিন্তা করো না। বিজ্ঞানীদের জন্য ফ্রিডম খুব জরুরি, টাকার অভাব না থাকা জরুরি। আমরা টিম তৈরি করলাম। চারজনের টিম– অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ এলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিবদ্যালয় থেকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থেকে এলেন অধ্যাপক নিহাদ আদনান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলেন অধ্যাপক রাহেদ জমিরুদ্দীন, আর ছিলেন আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানী আহসানুল হক। আমাদের সর্বাধিনায়ক ছিলেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ড. মহিবুল্লাহ খান। এই পাঁচজন মিলে আমরা পঞ্চপাণ্ডবের মতো কাজ করেছি।
এখন মুশকিল হলো, আমাদের কাঁচামাল আসবে কোথা থেকে? করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা ও প্রতিকারের ওষুধসামগ্রী তখন দুর্লভ হয়ে গেছে। তা ছাড়া বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় কিছু পাওয়া গেলেও আনানো যাচ্ছিল না। ভারত থেকে কিছু সামগ্রী আসার কথা কিন্তু পেলাম না। ইংল্যান্ড থেকেও হলো না। পরে চীনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা বলল, জিনিস আমাদের বিনামূল্যেই পাঠাবে। কিন্তু আনা হবে কী করে? স্যার ইউএস বাংলায় ফোন করলেন, চীনা দূতাবাস ও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দপ্তরেও যোগাযোগ হলো। স্যার সবকিছুর সমাধান করে দিলেন। বিমানবন্দর থেকে সবকিছু সরাসরি সাভারে চলে এলো। সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছেন, স্যার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। বিরাট আয়োজন ও উত্তেজনা। কিন্তু যে যন্ত্রটা লাগবে তা পাওয়া গেল না। সেটার বন্দোবস্তও স্যার করলেন। এক মাসের মধ্যে ল্যাবরেটরি তৈরি হয়ে গেল। ২৪ ঘণ্টা কাজ হতো। মোট ১০ জন বিজ্ঞানী থাকতাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো সাভারেরই পিএটিসিতে।
স্যার খোঁজখবর নিতেন, নিজেও চলে আসতেন। আরেকটা প্রডাক্ট আনতে হবে ভারত থেকে। কিন্তু বিমান চলাচল তো বন্ধ। জানা গেল ইউএস-বাংলার একটা প্লেন চেন্নাই যাবে সেখানে আটকে পড়া বাংলাদেশি যাত্রীদের আনতে। ঠিক হলো, সেই প্লেনেই আমাদের জিনিসও আসবে। কিন্তু ভারত সরকার শেষ মুহূর্তে আটকে দিল। তারা ইউএস-বাংলাকেও কালো তালিকাভুক্ত করতে চাইল। কিন্তু আমরা তাদের বোঝালাম যে, যখন এই প্রডাক্টের জন্য ভারতে অর্ডার করেছিলাম তখনও ভারত সরকার চিকিৎসাসামগ্রীর ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। এই যুক্তিতে আমরা ছাড় পেলাম। জিনিস দেশে চলে এলো।
আমাদের মধ্যে কোনো আক্ষেপ বা দুঃখ ছিল না। আমাদের কভিড-১৯ টেস্ট পদ্ধতি বাংলাদেশে বাজারজাত করতে পারেনি সত্য, কিন্তু পৃথিবী আমাদের থেকে এই ধারণা পেয়েছে। আমরা পথ দেখিয়েছি। সিরাম ট্রিটমেন্টও জাফরুল্লাহ সাহেব প্রথম নিয়েছেন, পরে পৃথিবী নিয়েছে। আমাদের মাস্কও আমেরিকার সিডিসি অনুমোদন দিয়েছে।
এর মধ্যে কোরবানি ঈদের আগে স্যার একদিন ফোন করে বললেন, তাঁর জ্বর জ্বর মনে হচ্ছে। লক্ষণ শুনে ভয় হলো। আমরা সেদিনই রাত ৮টায় আমাদের অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে টেস্ট করলাম। জানা গেল স্যারের কভিড পজিটিভ। স্যারের তো মেডিকেল অবস্থা খারাপ। কী করব? ওনাকে জানাব? সেই সাহস হলো না। আমি মহিবুল্লাহ সাহেবকে বললাম যে এই অবস্থা, কী করা যায়? তিনি বললেন, আমার কিছু করতে হবে না, তিনিই যা করার করবেন।
স্যার যদি ফোন করেন তো কী বলব, এই ভয়ে আমি বাসায় গিয়ে ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ফোন খুলে দেখি সাংবাদিকরা খুঁজছেন। টিভিতে দেখি আমার নামে খবর প্রচারিত হচ্ছে যে, আমি বলেছি জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত।
যা হোক স্যার বললেন, ‘বিজন, তুমি কি ভেবেছ আমি মরে যাব?’ স্যারের যে অবস্থা, সে সময় তাঁকে বাঁচানো মানে আজরাইলের মুখ থেকে টেনে আনা। সবচেয়ে বড় ছিল আতঙ্ক। এই আতঙ্কেও অনেকে মারা যেত। স্যারের ভেতর কোনো আতঙ্কই ছিল না। স্যার বললেন, ‘বিজন আমাদের তৈরি করা যন্ত্র দিয়ে আমার চিকিৎসা হচ্ছে, এটা ভালো।’ আমাদের সিরাম থেরাপি, প্লাজমা থেরাপিও দেওয়া হলো। স্যার সুস্থ হতে থাকলেন। তবে আমি চিকিৎসকদের পাশাপাশি তাঁর অটুট মনোবলের কথাও বলব। স্যার সে সময় বলেছিলেন, ‘বিজন আমি ভাগ্যবান। আমার করোনার সময় আমি প্রধানমন্ত্রীরও আশীর্বাদ পেয়েছি, বিরোধী দলেরও আশীর্বাদ পেয়েছি। সারাদেশের মানুষও আমার জন্য দোয়া করেছে।’
এর মধ্যে আমার নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা হলো। আমি তো সিঙ্গাপুরের নাগরিক। ঢাকায় গোলটেবিলে এসে বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ায় আটকা পড়ে গেছি। যাহোক, বাধ্য হয়ে আমাকে সিঙ্গাপুর চলে আসতে হলো। এর মধ্যে স্যার প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি লিখলেন যে, এই মুহূর্তে ড. বিজনের বাংলাদেশে থাকা উচিত।
তাঁর সঙ্গে কাজ করা আমার বিরাট সৌভাগ্য। আমাকে কেউ কাজে লাগায়নি; আমাকে কাজে লাগিয়েছিল গণস্বাস্থ্য। স্যারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। বঙ্গবন্ধুই তো গণস্বাস্থ্যের নাম দিয়েছিলেন। আগে ছিল জনস্বাস্থ্য।
গতবার চলে আসার আগে আমি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। সাভার থেকে ঢাকা আসা কষ্টকর ছিল। তা ছাড়া স্যারকে না বলতে পারতাম না। তিনি যদি বলতেন, ‘বিজন যেও না; আমার সঙ্গে কাজ করো’– আমি না করতে পারতাম না।
এই মানুষটা সংকটে সবার সামনে এসে দাঁড়ান। বন্যা হোক, সাইক্লোন হোক, মহামারি যাই হোক– মানুষের বিপদে তিনি বসে থাকতে জানেন না। নিজের সাধ্য যা, তার চেয়েও বেশি নিয়ে মানুষকে সাহায্য করেন।
আমাকে একদিন ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, বিজন তোমার কোনো লোভ নেই। আমি বললাম, আমি ধন্য। স্যার বললেন, লোভ ছাড়া কাজ হয় না। আমি বললাম, আমি নির্লোভ থেকেই কাজ করে যাব। আমি ভালো নেতা পেয়েছিলাম। তিনি আমার জীবনের সেরা মেন্টর, সেরা নেতা, সেরা পৃষ্ঠপোষক। বিজ্ঞানকে তিনি বিশ্বাস করেন। অনুমানের ভিত্তিতে কিছু করেন না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে আইডিয়া বা সমস্যা সম্পর্কে বুঝে নেন।
তিনি একজন সফল মানুষ। এই বয়সে, শারীরিক দুর্দশা নিয়ে তিনি যে কাজ করে যাচ্ছেন, এটা বিরল। তাঁর মতো অবস্থায় কেউ তো বিছানা থেকেই উঠতে পারেন না। সেখানে তিনি তৎপর থাকছেন, হুইলচেয়ারে করে ছুটে যাচ্ছেন রাজপথে, বৈঠকে, সেমিনারে, শহীদ মিনারে। সত্যিই জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজনই। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে চাই– ‘এই পৃথিবী একবার পায় তাকে, পায়নাকো আর।’
অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল: ভ্যাকসিন, বিশেষত কভিড-১৯ গবেষক। বাংলাদেশের জন্য নিজস্ব কভিড-১৯ ভাইরাস পরীক্ষা ও চিকিৎসায় বিরল অবদান রেখেছেন। সিঙ্গাপুরের প্রিন্স অব সোঙ্কলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর