এক চা-শ্রমিক কন্যার জনপ্রতিনিধি হওয়ার গল্প

0
50
খায়রুন আক্তার

চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করতে গিয়ে মনে হয়েছে, আন্দোলন করেন নারীরা আর কথা বলেন পুরুষেরা। নারীরা নিজেদের কথা বলতে পারেন না। নারীদের দমিয়ে রাখা হয়। এ চিন্তা থেকে নির্বাচনে আসা।’ কথাগুলো বলছিলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয়ী চা-শ্রমিক খায়রুন আক্তার (২৬)।

খায়রুন আক্তার হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা-বাগানে বসবাস করেন। তিনি চান্দপুর চা-বাগানের একজন নিয়মিত চা-শ্রমিক। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে খায়রুন তৃতীয়। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগেই। বাবাহারা খায়রুন তাঁর মা মুল্লিকা খাতুনকে নিয়ে বাগানের পাশেই থাকেন। এ বাগানে শুধু ওই পরিবার নয়, আরও ২০টি মুসলিম পরিবারের বসবাস। ব্রিটিশ শাসনামলে অন্যান্য চা-শ্রমিকেরা যেভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে আসেন, খায়রুনের পরিবারও সেভাবেই এসেছিল।

বাবা মো. মজিদ মিয়া ২০১২ সালে মারা যাওয়ার পর মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে অনেকটা বিপাকে পড়েন খায়রুন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে আর্থিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ে পরিবারটি। তখন পরিবারের হাল ধরতে হয় উপজেলার অগ্রণী উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী খায়রুন আক্তারকে। বাবার কর্মস্থল চান্দপুর চা-বাগানে ২০১৩ সালে নিয়মিত চা-শ্রমিক হিসেবে চাকরি হয় তাঁর।

প্রথম প্রথম পোকামাকড়ের আক্রমণ, কড়া রোদ, প্রচণ্ড গরম—এমন নানা পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। সে সময়ের কথা মনে করে এখনো কাঁদেন তিনি। তিনি বললেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করে আরও বড় কিছু হই। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে। ২০১২ সালে বাবার ক্যানসার ধরা পড়ে। গরু-ছাগল বিক্রি করে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু বাবাকে বাঁচানো যায়নি। বাবার অসুখের জন্য এসএসসির টেস্ট পরীক্ষাটা আর দেওয়া হয়নি।’ এরপর বাবার পেশাতেই যুক্ত হন তিনি।

নারীদের কথা ভেবে ২০২০ সালে ‘বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সমিতি’ গঠন করেন খায়রুন। এ সংগঠনের সভাপতি তিনি। স্থানীয় লোকজনের কাছে খায়রুন ‘চা কন্যা’, ‘অগ্নিকন্যা’, ‘স্লোগান কন্যা’সহ নানা নামে পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন করি, তাই বাগানমালিকেরা আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। তবে সাধারণ শ্রমিকেরা বেশ পছন্দ করেন।’

চা-বাগানগুলোতে ২০২২ সালে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন শুরু হয়। ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চা-শ্রমিকদের আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন খায়রুন। মিছিলের সামনে থেকে তিনি স্লোগান ধরতেন। তাতে অন্য শ্রমিকেরা কণ্ঠ মেলাতেন। তবে মাইকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেতেন না।

এভাবে আন্দোলনে যুক্ত থাকতে থাকতে খায়রুনের মনে হয়েছে, নারীদের সামনে রেখে আন্দোলন করা হলেও তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। তখন তাঁর মনে হয়েছে, নারীদের কথা বলার অধিকার আদায় করে নিতে হবে। তাঁর ভাষায়, ‘ভাবলাম, নারীদের কথা বলার অধিকার তৈরি করতে কোনো এক নারীকে এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য একটি পদ দরকার। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পদ তৈরি করতে হবে। এ চিন্তা থেকেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আসা।’

নির্বাচন করার জন্য যে খরচ, সেই টাকা জোগাড় প্রসঙ্গে খায়রুন আক্তার বলেন, তিনি নির্বাচনে লড়বেন শুনে চা-বাগানের লোকজন গণচাঁদা তোলেন। নিজের ঘরের হাঁস-মুরগি বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। পরে স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন খায়রুন।

৫ জুন উপজেলা পরিষদের চতুর্থ ধাপের নির্বাচনে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ছিলেন খায়রুল আক্তারসহ চারজন। ফলাফলে খায়রুল তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে ৬৪ হাজার ২৬০ ভোট বেশি পেয়ে জয়লাভ করেন। হবিগঞ্জে প্রথম কোনো নারী চা-শ্রমিক জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইতিহাস গড়েন তিনি। সামনের দিনের লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার প্রতি এতগুলো মানুষ আস্থা রেখেছেন, আমাকে এ জয় ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি আমি বাগানে যে কাজ করি, সে কাজ ধরে রাখব। কারণ, সেই কাজের মাধ্যমেই আমার এত দূর আসা।’

হবিগঞ্জ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.