একুশে পদক পাওয়ায় বাড়িতে মানুষের ভিড়, জিয়াউল হক ব্যস্ত দই বিক্রিতে

0
108
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর স্টেশন বাজারে পথের পাশে বসে দই ও ক্ষীর বিক্রি করছেন জিয়াউল হক। গতকাল বুধবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মঙ্গলবার রাত থেকেই খবরটি ছড়াতে থাকে। মো. জিয়াউল হক একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ায় গ্রামের মানুষ, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল বুধবার সকাল থেকে শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁর বাড়িতে ভিড় জমান, অভিনন্দন জানাতে সঙ্গে নিয়ে আসেন ফুলের তোড়া। কিন্তু জীবিকার তাগিদে তখন দই বিক্রি করতে বেরিয়েছেন ৯০ বছর বয়সী জিয়াউল হক।

সমাজসেবায় এবারের একুশে পদকের জন্য মনোনীত জিয়াউল হক চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মুসরিভূজা বটতলা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ফেরি করে দই বিক্রি করেন। সেই আয়ে সংসার চালানোর পর উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে বই কিনে তিনি গরিব ছাত্রদের মধ্যে বিলি করেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সম্মতিপত্রে জিয়াউল হকের মনোনয়নের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন

গতকাল সকালে মুসরিভূজা বটতলা গ্রামে গিয়ে জানা যায়, জিয়াউল হক পাশের গোমস্তাপুর উপজেলা সদর রহনপুর স্টেশন বাজারে দই বিক্রি করতে গেছেন। বাড়িতে তখন শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভিড়। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রহনপুর স্টেশন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, একটি ওষুধের দোকানের সামনে বসে দই বিক্রিতে ব্যস্ত জিয়াউল হক।

এ সময় জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দই ও ক্ষীর নিয়ে আমি সকাল সাতটায় বের হয়েছি। কেননা চাল কেনা ও বাজার করার টাকা ছিল না। আমি কল্পনা করতে পারিনি, যে আমি এত বড় একটা পদক পাওয়ার জন্য মনোনীত হব। জীবনের শেষ দিকে এসে কাজের স্বীকৃতি পেলাম। এখন মরেও শান্তি পাব। কী যে আনন্দ পেয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’

পথের পাশে দই কিনতে এসে ক্রেতারাও জিয়াউল হককে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলছিলেন। প্রসাদপুর মাদ্রাসাপাড়ার নাসির উদ্দীন (৪৭) শৈশবকাল থেকে দেখে আসছেন জিয়াউল হক মাথায় দইয়ের ডালি নিয়ে, সাইকেল চালিয়ে দই বিক্রি করে আসছেন। তাঁর দইয়ের সুনাম আছে উল্লেখ করে নাসির উদ্দীন বলেন, ‘তিনি দই বিক্রি করে সংসার চালানোর পর উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে বই কিনে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বিলি করেন। বাড়িতে তাঁর নামে একটি সাধারণ পাঠাগার গড়েছেন। শুধু তা–ই নয়, গরিব–অসহায় নারীদের অনেককে বাড়ি করে দিয়েছেন। গ্রামে গ্রামে নলকূপ বসিয়ে দিয়েছেন। অসহায় মানুষদের খাদ্য ও বস্ত্র দিয়েও সহায়তা করে আসছেন অনেক বছর থেকে। গোটা জেলাতেই সাদা মনের শিক্ষানুরাগী মানুষ হিসেবে তাঁর ব্যাপক সুখ্যাতি রয়েছে।’

একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ায় জিয়াউল হককে অভিনন্দন জানাচ্ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা স্কাউটসের সদস্যরা। গতকাল বুধবার বিকেলে জিয়াউল হকের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারে

দুপুর ১২টার দিকে জিয়াউল হক দই ও ক্ষীরের পাত্র নিয়ে বিক্রি করতে যান ইসলামী ব্যাংকের রহনপুর শাখায়। তাঁকে দেখে ব্যাংকের কর্মকর্তারা একে একে চেয়ার ছেড়ে এসে দই, ক্ষীর কিনে নেন। তাঁকে অভিনন্দন জানান, আনন্দ প্রকাশ করে এবং তাঁর সঙ্গে একে একে ছবি তোলেন।

দই ও ক্ষীর বিক্রি শেষে রহনপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোরিকশায় করে বাড়ির পথে রওনা দেন জিয়াউল হক। পথে যেতে যেতে তিনি জীবনের গল্পের ঝাঁপি খুলে ধরেন কাছে। গল্পে গল্পে জিয়াউল হক জানান, ১৯৫৫ সালে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে চান। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গরুর দুধ দহন করে জীবিকা নির্বাহ করা বাবা বই কেনার জন্য দেড় টাকা দিতে পারেননি। উচ্চবিদ্যালয়েও ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠেনি আর। এরপর বাবার সংগ্রহ করা দুধ দিয়ে দই তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। দু–তিন বছর পর কিছু টাকা জমা হয় জিয়াউল হকের হাতে।

তখন জিয়াউল হকের চিন্তা হয়, যারা তাঁর মতো টাকার অভাবে বই কিনতে না পেরে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়তে পারে, তাদের তিনি এই টাকা দিয়ে বই কিনে দেবেন। তবেই তাঁর বিদ্যালয়ে পড়তে না পারার বেদনা লাঘব হবে। গরিব ছাত্রদের মধ্যে বই বিলি শুরু করেন। যত দিন পর্যন্ত সরকার বই বিনা মূল্যে দেওয়া শুরু করেনি, তত দিন পর্যন্ত বই দিতে থাকেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণির ছাত্রদের বই দিতে থাকেন জিয়াউল। তাঁর দেওয়া বই পড়ে ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে অনেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করছেন। শুধু তা–ই নয়, দই বিক্রি করা টাকায় বইয়ের ভান্ডার গড়ে তোলেন। ১৯৬৯ সালে নিজের বাড়ির একটি ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’। এ পাঠাগারে এখন ১৪ হাজার বই আছে বলে জানান জিয়াউল হক।

পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বইও আছে পাঠাগারে। সব বই রাখার স্থান না হওয়ায় সেই বইগুলো আছে পাশের মুসরিভূজা ইউসুফ আলী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজসহ আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠাগারে।

নিজের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারে জিয়াউল হক

জিয়াউল হক বলেন, ‘শুধু পাঠ্যবই পড়ে ছাত্রদের জ্ঞান অর্জন হবে না মনে করেই আমি নিজের নামে সাধারণ পাঠাগার স্থাপন করেছি। ১৯৯৩ বা তারও পরে ভোরের কাগজে ‘দইওয়ালার বই ভান্ডার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের তৎকালীন কর্মকর্তা ও বর্তমানের টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আমার বাড়িতে এসে পাঠাগারের জন্য এক লাখ টাকা অনুদান দিলে পাঠাগার সমৃদ্ধ হয়। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে প্রবাসে থাকা মানুষজন, দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষজন আমাকে আর্থিক সহায়তা দিতে থাকেন। আমি কলেজ পর্যায়ের গরিব ছাত্রদের মধ্যে বই বিলির পাশাপাশি গরিব–অসহায় মানুষ ও এতিমদের সাহায্য করতে সমাজসেবামূলক কাজে নেমে পড়ি। এ জীবনে অনেক সম্মাননা পেয়েছি। তবে একুশে পদক কখনো পাব ভাবিনি।’

বাবার এমন অর্জনে উচ্ছ্বসিত ও গর্বিত জিয়াউল হকের ছেলে মহব্বত হক। তিনি বলেন, ‘এমন বাবার সন্তান হয়ে আমি গর্বিত। বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার কাজ চালিয়ে যাব। একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ার খবরে বাবা অনেক আনন্দ পেয়েছে। আমার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। গতকাল সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। ফোনে মানুষের অভিনন্দন শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.