একটি জারুলবাড়ি

0
103
পণ্ডিতবাড়ি প্রবেশের পথ। দুই পাশে ঝাঁকে ঝাঁকে জারুলগাছে আনন্দের বান বয়ে যাচ্ছে যেন। গত সোমবার ভোলা সদরের ধনিয়া ইউনিয়নে

স্থানীয় আবৃত্তিশিল্পী মশিউর রহমান ভোর ভোর বাড়িতে এলেন। উঠিয়ে নিলেন তাঁর মোটরবাইকের পেছনে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, তার রহস্য ধরে রেখেছেন। সচরাচর আমরা ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলী এলাকায় মেঘনা নদীর তীরে বেড়াতে যাই। মোটরবাইক সেদিকের পথ ধরেই চলছিল। ধনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবন পার হতেই বাইক ডান দিকের চিকন পিচঢালা পথে বাঁক নিল। চিরাচরিত গন্তব্য এটা নয়।

রাস্তার বাঁ পাশে ১৬৯ নম্বর দক্ষিণ ধনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের কাছেই হাজি আবদুল করিম পণ্ডিতবাড়ি। স্কুলটি পার হতেই নাকে এসে ঝাপটা দিল পরিচিত চেনা মিষ্টি ফুলের ঘ্রাণ। জারুল নাকি?

পণ্ডিতবাড়িতে ঢুকতেই মনে হলো কোনো উদ্যানে এসে প্রবেশ করেছি। ঢোকার পরপরই যে পথটা, তার দুই পাশে, বাগানে, পুকুরপাড়ে, আঙিনায় ফুলগাছের পর ফুলগাছ। ভোরের খেয়ালি শীতল হাওয়ায় দুলছে গাছে গাছে রাশি রাশি ফুল। থোকা থোকা বেগুনি রঙের ফুল। সারি সারি জারুলগাছে আনন্দের বান বয়ে যাচ্ছে যেন।

ভোলায় এদিক–সেদিকে এলোমেলোভাবে জারুল ফুলের গাছ আছে অনেক জায়গাতেই। কিন্তু একটা বাড়িতে এত জারুল! চোখ ছাপিয়ে মনের মধ্যে হানা দেয়। বাড়িজুড়ে ৩০টির বেশি জারুল ফুলের গাছ। নারকেল, সুপারি, সোনালুসহ আরও নানান গাছ তো আছেই।

পণ্ডিতবাড়ির পুব পাশে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর মেঘনা নদীর তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বাড়ি ভেদ করে চলে যাওয়া পিচঢালা সড়কটি গিয়ে মিলেছে বাঁধের সঙ্গে। সেই সড়ক দিয়ে বাঁধের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনটা জুড়িয়ে গেল।

বাড়ির বাসিন্দা তোফাজ্জল হোসেন পণ্ডিতের বয়স ৬৫ বছর। তিনি বললেন, ৩২ একর জমির এই বাড়ির বয়স দুই শতকের বেশি। বাড়ির বেশির ভাগ ভেঙে তলিয়ে গেছে মেঘনা নদীর গর্ভে। একসময় এ বাড়িতে ছিল নারকেল-সুপারির বিশাল বনানী। কিন্তু জারুল বাড়িটিকে দিয়েছে নিজস্ব এক চেহারা।

ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে আসছেন, বাড়ির আঙিনাজুড়ে বেগুনি ফুলের প্লাবন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে বাগানের চেহারা যেত পাল্টে। ভাঙনের কারণে জমি কমে গেছে। বসতির সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতিবছর গাছ কাটা পড়ছে। তাই টান পড়েছে জমিতে। তোফাজ্জল হোসেন পণ্ডিতের দুঃখ, শৈশবের অত জারুলগাছ এখন নেই বললেই চলে। তিনি বললেন, একসময় জারুলগাছ পুরো বাড়ি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। বীজ পড়ে গাছ হতো যত্রতত্র।

এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাগানটিই ছিল এই পণ্ডিতবাড়িতে, জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা ভোলা ইসলামীয়া ইউনানি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক মহিউদ্দিন। বললেন, ‘এই বাগানে জারুলের পাশাপাশি ছিল বড় বড় গাছ। আরও ছিল মান্দারগাছ। বাগান ভরে যেত শত শত বক আর পানকৌড়িতে। অল্প বয়সে এই বাগানে ফুল আর বকের ছানা কুড়াতে আসতাম।’

উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলেন, জারুল এই সজল মাটিরই একটি অন্তরঙ্গ গাছ। এর আদি নিবাস বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের জলাভূমি অঞ্চল। জলাভূমির আশপাশের জনপদেই গাছটি বেশি দেখা যায়। পানিপ্রিয় বলে জলাভূমিতে বেড়ে ওঠে সত্য, তবে শুকনা এলাকায়ও নিজেদের বেশ মানিয়ে নিতে পারে। অনেক শহর ও পাহাড়ি এলাকায়ও জারুল দেখা যায়।

জারুল ফুলের গাছ ১০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের শুরুতে জারুলের ফুল ফুটতে আরম্ভ করে। শরৎ পর্যন্ত ফুল ফুটতে দেখা যায়। গ্রীষ্মে কচি পাতাভরা গাছের ডালে ডালে থোকা থোকা বেগুনি রঙের নজরকাড়া ফুল ফোটে। ফল ডিম্বাকার ও শক্ত।

জারুলের কাঠ লালচে; অত্যন্ত শক্ত ও মূল্যবান। জারুলকাঠ দিয়ে ঘরের কড়ি-বরগা, লাঙল, নৌকা ও আসবাব তৈরি করেন মানুষেরা। জ্বর, অনিদ্রা, কাশিতে জারুলের ভেষজ গুণের প্রয়োগ দেখা যায়।

উপকূলীয় বন বিভাগের সদর উপজেলা রেঞ্জার মো. সাইফুল ইসলাম জানালেন, ভোলার বিভিন্ন বাড়ির বাগানে ও পুকুরপাড়ে জারুলগাছ লাগানো হচ্ছে। প্রতিবছর তাঁরা ১২০ থেকে ১২৫টি জারুলের চারা উৎপাদন করছেন।

পণ্ডিতবাড়ির ফুলবাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আর বাঁধের সড়কে হাঁটতে হাঁটতে সূর্য অনেকটাই উঠে আসে নোয়ানো দিগন্ত থেকে। জেগে উঠতে শুরু করে সকালের কোলাহল।

ফিরে আসার পথে মোটরসাইকেলের শব্দের সঙ্গে মিশে যায় মশিউর রহমানের কণ্ঠ। তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা গুনগুন করছেন, ‘ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর—চিল একা নদীটির পাশে/ জারুল গাছের ডালে ব’সে ব’সে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে…।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.