এমরান ‘খুন’ হয়েছেন, কিন্তু উদ্ধার হওয়া লাশটি কার

0
125

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হারিন্দা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন মো. এমরান (২৪)। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি নিখোঁজ হন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শীতলক্ষ্যায় একটি লাশ ভেসে ওঠে। লাশটি এমরানের বলে শনাক্ত করে পরিবার।

এমরান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার একাধিক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, উদ্ধার হওয়া লাশটি এমরানের নয়, অজ্ঞাত কোনো নারীর।

এমরানের পরিবারের অভিযোগ, টাকা দিয়ে প্রতিবেদন পরিবর্তন করেছেন আসামিরা। আর তাঁরা এখন মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছেন।

অবশ্য মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক হাসিনা বেগম বলেছেন, প্রতিবেদনে যা-ই আসুক না কেন, এমরান যে খুন হয়েছেন, তা নিশ্চিত। একাধিক আসামি জবানবন্দিতে এমরানকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন।

২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ হয়েছিলেন এমরান। তিনি স্থানীয় একটি কলেজে পড়তেন। পাশাপাশি বালুর ব্যবসা করতেন। এমরানের খোঁজ না পেয়ে ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর রূপগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পরিবার। ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শীতলক্ষ্যা নদীতে একটি গলিত লাশ ভেসে ওঠে। লাশটি এমরানের বলে শনাক্ত করে পরিবার। ২৩ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন এমরানের বড় ভাই মো. মোস্তফা। মামলায় সাত আসামির নাম উল্লেখ করা হয়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত প্রায় ছয় বছরে চারবার মামলার তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হয়েছে। শুরুতে মামলাটি তদন্ত করে রূপগঞ্জ থানা-পুলিশ। অগ্রগতি না হওয়ায় মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ জেলা ডিবিকে। পরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। প্রায় চার বছর তদন্ত করে তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। বাদী নারাজি দিলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। এক বছর ধরে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করছে। মামলায় মোট ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁরা সবাই এখন জামিনে আছেন।

মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে ডিবি, পিবিআই ও সিআইডি পৃথকভাবে ফরেনসিক ল্যাবে লাশটির ডিএনএ পরীক্ষা করে বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তিনবার ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবারই প্রতিবেদনে দেখা যায়, লাশটি এমরানের নয়, কোনো এক অজ্ঞাত নারীর। তবে এই নারী কে, তা শনাক্ত করতে পারেনি তদন্তকারী কোনো সংস্থা।

সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডিএনএ পরীক্ষায় কোথাও ভুল হচ্ছে। কারণ, একাধিক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তাঁরা এমরানকে হত্যার পর তাঁর লাশ শীতলক্ষ্যার যে স্থানে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বিদ্যুতের তার দিয়ে বেঁধে রাখার কথা বলেছেন, সেখান থেকেই সেটি উদ্ধার করা হয়েছিল। এমরানের মা ও ভাই লাশটি শনাক্ত করেছিলেন। তারপরও ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে লাশটি কোনো নারীর বলে তথ্য আসার বিষয়টি রহস্যজনক।

সিআইডির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সমসাময়িক সময়ে রূপগঞ্জে কোনো নারী নিখোঁজ হয়েছিলেন কি না, থানায় এমন কোনো জিডি হয়েছিল কি না—এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এমরানের লাশ সরিয়ে সেখানে অজ্ঞাত কোনো নারীর লাশ রাখা হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক হাসিনা বেগম বলেন, আসামিদের স্বীকারোক্তিতে এমন কিছু আসেনি।

এমরানের বড় ভাই মো. মোস্তফা বলেন, তিনি ও তাঁর মা ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ দেখেছিলেন। লাশের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিল না। তবে বুকের লোমসহ কিছু বিষয় দেখে তাঁরা লাশটি এমরান বলে শনাক্ত করেন। গ্রেপ্তারের পর একাধিক আসামি জবানবন্দিতে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। কিন্তু পরে আসামিরা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করেছেন। এভাবেই প্রতিবেদন পরিবর্তন করা হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।

মোস্তফা আরও বলেন, আসামিরা এখন মামলা তুলে নেওয়ার জন্য তাঁকে হুমকি দিচ্ছেন। আসামিরা বলেছেন, তাঁরা কোটি টাকা খরচ করে প্রতিবেদন পরিবর্তন করেছেন। মামলা তুলে নিলে তাঁকে বড় অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে। তাঁদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাঁকে ও তাঁর বড় ভাইকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

মো. এমরানের মা মফিজা খাতুন।

পাঁচ আসামির জবানবন্দি

এমরান হত্যা মামলায় সাত আসামির নাম উল্লেখ করা হয়। তাঁরা হলেন দোহাই (শামছুল হক), রাজিব, দুলাল, সজিব, রমজান, রাজীব মিয়া ও মিছির আলী।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলায় গ্রেপ্তার পাঁচ আসামি এমরানকে হত্যা ও পরে তাঁর লাশ গুমের বিষয়টি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেন।

আদালত সূত্র জানায়, শামছুল তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, এমরানসহ তাঁরা কয়েকজন মিলে বালু ভরাটের ব্যবসা করতেন। ওমেরা হাউজিং নামের একটি আবাসন প্রকল্পের বালু ভরাটের কাজ করছিলেন তাঁরা। বালু ভরাটের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে এমরানের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ হয়। এই বিরোধের জেরে এমরানকে সজিব বাসায় ডেকে আনেন। সেখানে তাঁরা একসঙ্গে নেশা করেন। একপর্যায়ে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা এমরানকে হত্যা করেন।

মহসিন তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, গলা কেটে হত্যার পর এমরানের মাথা, হাত, পা আলাদা করা হয়। এগুলো শীতলক্ষ্যা নদীর বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেন রমজান ও রাজীব। পরে এমরানের শরীর বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বিদ্যুতের তার দিয়ে বেঁধে শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে রাখা হয়।

মামলার বাদী মোস্তফা বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর থেকে এমরানের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। পরে তাঁরা আত্মীয়স্বজনের বাসায় খোঁজ নেন। কিন্তু তাঁকে কোথাও পাওয়া যায়নি। ঘটনার প্রায় ১৭ দিন পর শামছুল এলাকায় আসেন। তখন শামছুলের কাছে এমরানের খোঁজ নিতে গেলে তিনি রেগে যান।

পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদন

প্রায় চার বছর তদন্ত করে এই হত্যা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পিবিআই। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, এমরান নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি আগেও পরিবারকে না জানিয়ে বাসা থেকে চলে যেতেন। তাঁর খুন হওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে যে লাশটি উদ্ধার করা হয়েছিল, সেটি এমরানের নয়, এক নারীর।

মামলার বাদী মোস্তফা অভিযোগ করে বলেন, পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ায় তাঁরা হতাশ হন। তিনি পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেন। এদিকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে তাঁদের হুমকি দিতে থাকেন।

আতঙ্কে পরিবার

এমরানের মা মফিজা খাতুন বলেন, ছেলে হত্যার বিচারের জন্য তাঁরা ছয় বছর ধরে অপেক্ষা করছেন। গ্রেপ্তার আসামিরা জামিনে বেরিয়ে গেছেন। তাঁরা এখন তাঁর দুই ছেলেকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। তিনি তাঁর ছেলে হত্যার বিচার তো পেলেনই না, উল্টো এখন তাঁদের দিন কাটছে আতঙ্কে।

মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক হাসিনা বেগম বলেন, তদন্ত শেষ হয়েছে। দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.