আজ চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুদিন। ২০১১ সালের এই কথোপকথনে পাওয়া যাবে অন্য এক ঋতুপর্ণ ঘোষকে, সোহানি ঘোষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যিনি নিজেই নিজের চলচ্চিত্রগুলোর নানা বিষয় ব্যাখ্যা করছেন। অধ্যাপক সোহিনি ঘোষ দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এ জে কে মাস কমিউনিকেশন রিসার্চ সেন্টারের ‘সাজ্জাদ জহির চেয়ার’। সোহিনি আর ঋতুপর্ণ একই সময়ে একই শহরে বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাঁদের দুজনের বন্ধুত্বের শুরু আরও পরে—একটা নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে এসে যখন দুজন দুই শহরে থাকেন, তখন। স্থানিক দূরত্ব তাঁদের নিবিড় বন্ধুত্বে কোনোরকম বাধা হতে পারেনি। বেশ কয়েকটি বিষয়ে আগ্রহ ও ভালোলাগার মেলবন্ধনের কারণে তাঁদের সেই বন্ধুত্ব বজায় ছিল আজীবন। ২০১১ সালের জুলাইয়ে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনস্টার আয়োজিত এক সম্মেলনে তাঁদের দুজনের এই সাবলীল আলাপচারিতায় উঠে এসেছে চলচ্চিত্রসহ বিচিত্র বিষয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের অনুভব আর ভাবনা। সোহিনি ঘোষের অনুমতি নিয়ে কথোপকথনটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন নাফিস সাদিক।
সোহিনি ঘোষ: এই সম্মেলনের থিমের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, এমন একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে চাই। তোমার ছবিতে কী নতুন, বা বর্তমান সময়ে কোন জিনিসগুলো তোমার নিজের কাছে নতুন?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: মৃত্যুর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা… (হঠাৎ থেমে গিয়ে সোহিনির দিকে তাকাল)
সোহিনি ঘোষ: আরেকটু খুলে বলো…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: এর পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। আমার মা মারা গেছেন পাঁচ বছর হলো। মার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মৃত্যু আমার কাছে ছিল কল্পনাশ্রয়ী, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু খুব কাছের কারও মৃত্যু যখন কাছ থেকে দেখলাম… এতদিন যা আমার কাছে বিমূর্ত ছিল, তা বাস্তবে রূপ নিল। মাকে দাহ করার মুহূর্তটা বাদে ‘মৃত্যু’ আমার কাছে এক রকম অধরাই ছিল। কোনো কিছুই বদলেছে বলে মনে হচ্ছিল না। দেহটাও একই রকম ছিল। শ্মশানঘাটে গিয়ে আমি প্রথমবার অনুভব করলাম, মা আর নেই। যখন আমি একগালে চুমু দিলাম, অন্য গালটা মা আর বাড়িয়ে দিল না। আমাকে নিজে ঘুরে আরেক পাশে গিয়ে অন্য গালে চুমু দিতে হলো। আমি প্রথমবার তখন বুঝলাম, দেহ চিরকালীন না, এর-ও মৃত্যু ঘটে। আমরা সবাই এটা জানি, কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত মৃত্যু আসে তার আগ পর্যন্ত অনুভবটা ঠিক আসে না। সেবার আমার প্রথমবারের মতো মৃত্যু বোঝার অভিজ্ঞতা হলো। কিন্তু মৃত্যুর সঙ্গে থাকা বিমূর্তভাবটা রয়ে গেল… আমিও এটার কোনো সমাধান চাইনি। কারণ মা আগে যতটা বেঁচে ছিলেন, মরে গিয়ে তার থেকে আরও বেশি জীবন্ত হয়ে আমার মধ্যে বেঁচে রইলেন। মৃত্যুর মতো জীবনের এক ধ্রূব সত্যের সঙ্গে বোঝাপড়া, বিমূর্ততার সঙ্গে নিজের এই লড়াই… সেটাই আমার ছবিতে কিছু বিমূর্ততা আনতে, বলা যায় আমাকে এক প্রকার বাধ্য করল। মৃত্যু, বিরহ, শোক ও হারানোর যন্ত্রণা আমার প্রিয়তম সঙ্গী হয়ে উঠল।
এখন কি কিছুটা বোঝাতে পেরেছি?
সোহিনি ঘোষ: হ্যাঁ। তবে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইছ…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: হুম… কারণ বাবা-মার মৃত্যু তোমার আর আমার—দুজনের মধ্যে একটা বন্ধনের জন্ম দিয়েছে…
সোহিনি ঘোষ: …বলা ভালো… আমাদের দুজনের মায়ের মৃত্যু…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: …প্রথমে আমাদের মায়ের মৃত্যু, তারপর আমাদের বাবার মৃত্যু। কাজেই আমাদের দুজনের বন্ধন আমাদের বাবা-মা, বিশেষ করে তাদের চলে যাওয়ার সঙ্গে বেশ সম্পর্কযুক্ত।
সোহিনি ঘোষ: তোমার একটা ছবির জন্য আমরা দুজন একসঙ্গে কাজ করেছি। ওর লেখা চিত্রনাট্যগুলোর মধ্যে এটা একদম শুরুর একটা। এ ছবিটার নাম ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৮)। পরস্পরের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল এমন এক দম্পতিকে নিয়ে ছবিটা বানানো। এখানে স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে এবং অন্য একজন পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। স্বামীকে সে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাস্তবে ছেড়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু ঘটে স্বামীর। এ ছবির বাকিটা মৃত স্বামীর সাথে তার স্ত্রীর বন্ধন গড়ে ওঠার গল্প…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: এটাকে একটা ‘মৃত্যু পরবর্তী প্রেমে’র গল্পও বলা যেতে পারে…
সোহিনি ঘোষ: হ্যাঁ, কারণ আমরা দুজনেই অনুভব করেছি যে প্রিয়জনেরা মরে গেলেই আমাদের ছেড়ে যান না। উল্টো জীবিত ও মৃত—দুধরনের মানুষকে নিয়ে আমাদের নতুন জগৎ গড়ে ওঠে। মূলত এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে ছবিটা।
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আমি এখানে একটা জিনিস যোগ করতে চাই, সেটা নিয়ে শুরুতেই আমাদের কথা হচ্ছিল। মূলত যে ধরনের ছবি আমি আগে বানাচ্ছিলাম, যেসব ছবি শিক্ষিত–রুচিশীল দর্শকদের সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনছিল, সেগুলো একই ধাঁচের অন্যান্য নির্মাতা, যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, মৃণাল সেন বা গৌতম ঘোষের বানানো নন-মেইনস্ট্রিম সিনেমাগুলোর থেকে অনেকটা আলাদা। তাঁদের সিনেমায় বাংলা ছবির স্বাতন্ত্র্য থেকে বিশ্ব সিনেমার অনুরণন বেশি। অন্যদিকে আমার ছবিগুলো বিশ্ব সিনেমার নির্যাস গ্রহণ করে এবং সেখানের নন্দনতাত্ত্বিক বোধের আলোকে উপস্থাপিত ‘বাংলা ছবি’–ই বলব। ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’–এরও বাংলা ভাষার সঙ্গে যোগ অনেক বেশি। এখানের স্বামী চরিত্রটি একজন বাঙালি কবি।
অন্যদিকে তার স্ত্রীর বেড়ে ওঠা বাংলার বাইরে, বাংলা ভাষার সঙ্গে তার যোগাযোগ যথেষ্ট কম। মৃত স্বামীর সঙ্গে তার বন্ধন তৈরি হয় অডিও-সিডি থেকে, তার লেখা বাংলা কবিতা শোনার মাধ্যমে।
সোহিনি ঘোষ: কাজেই এখানে কেবল মৃতের সঙ্গে তার স্ত্রীর নতুন সম্পর্ক নয়, একটা ভাষার সাথেও তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যে ভাষাকে একসময় সে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
স্বামীর মৃত্যুর পরে রাধিকা (বিপাশা বসু) একদিন অফিস শেষে ঘরে ফেরে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার পর সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, যাতে উপস্থিত প্রতিবেশী বিদায় নেয় এবং রাধিকাকে তার মুখোমুখি না হওয়া লাগে। এরপর ডোরবেল টেপে। একটা লং শটে দেখা যায়, বাড়ির কাজের লোক নন্দর মা (সোহাগ সেন) দরজা খুলে তাকে জড়িয়ে ধরে। রাধিকা নিজের ঘরে বসে কিছু একটা ভাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে আবৃত্তি হয় তার মৃত স্বামীর লেখা একটি কবিতা। সে চেয়ার থেকে উঠে লাইট বন্ধ করে দেয় এবং বাথরুমের দরজার হাতল ঘোরায়। এরপর ভেতরে ঢুকে দেখে, বাথরুমটা নিমেষে পরিণত হয়েছে একটা বনে। অনেক মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে—বন্ধুবান্ধব, পরিচিত লোকজন, হাসপাতালের স্টাফ। সবাই ভিড় করে আছে হাতপাতালের বেডে থাকা কাউকে ঘিরে। ওই বেডে কে শুয়ে আছে? ইন্দ্রনীল (রাধিকার মৃত স্বামী চরিত্রে অভিনয় করা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) না কি? রাধিকা তার নাম ধরে ডাক দেয়। সবাই পেছনে ফিরে তার দিকে তাকায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে ‘লীলাবালি, লীলাবালি’, সঙ্গে দুর্গাপূজার ঢাকের শব্দও শোনা যায়।
রাধিকা উল্টো ঘোরে এবং রহস্যময় মেয়েটিকে আবার দেখতে পায়। মেয়েটি তাকে অনুসরণ করার জন্য রাধিকাকে ইশারা করে। বনের মধ্যে তার পিছুপিছু হাঁটতে থাকে রাধিকা। কিছু পরে তাকে একটা দরজা খুলতে দেখা যায় এবং একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে বুঝতে পারে, এটা তার নিজেরই বাড়ি। দরজা খোলার পর রাধিকার পেছনে ইন্দ্রনীলের একটা বিশাল সাইজের প্রতিকৃতি দেখা যায়, যেটা আরও কয়েক দৃশ্য আগে ইন্দ্রনীলের স্মরণসভায় দেখেছিলাম আমরা। ঢাকের শব্দ আর উলুধ্বনি তীব্রতর হয়ে ওঠে।
রাধিকাকে এবার নববধূর সাজে দেখা যায়, কিন্তু চেহারায় কিছুটা বিপর্যস্তভাব। পেছনে ধুতি-কোর্তা ও জ্যাকেট পরা শেখরকে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তার হাতে কাপড় দিয়ে ঢাকা একটা মাটির পাত্র। এ পাত্রে কি আছে? মিষ্টি, না কি শবদাহের ভস্ম? দেয়ালে অনেকগুলো ছায়া দেখা যায়, তবে বাস্তবে কারও দেখা পাওয়া যায় না। একটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের শাড়িতে কপালে সিঁদুর পরা নন্দর মাকে দেখা যায়। মনে হয় সে যেন নববধূকে বরণ করতে এগিয়ে আসছে। চারপাশের ছায়াগুলো ক্রমশ তাকে ঘিরে ধরতে থাকে, এমন সময় রাধিকা বিয়ের দিনের সাজে তার স্বামীকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখতে পায়। সে প্রথমে ইন্দ্রনীলের দিকে তাকায়, এরপর চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ওর দাড়ি কামিয়ে দিল কে?’
ঋতুপর্ণ ঘোষ: সমস্ত বাড়িটা ফুলে সাজানো। কারণ শেষকৃত্য ও বিয়ে—দুটো আয়োজনেই অনেকগুলো জিনিস মিলে যায়। বধূবেশে প্রথম ঘরে ঢাকা এবং বিধবা হবার পর আবার ঘরে ঢোকার রীতিনুষ্ঠানেও কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। আরেকটা ব্যাপার হলো, আমি এখানে ‘বাস্তব’কে সমাপতিত করতে চেয়েছি স্বপ্নের ওপর। অপর্ণা সেনের ছবি ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’–এর (১৯৮১) স্বপ্নদৃশ্যটার কথা ভাবতে পারো। ওই ছবির মূল চরিত্র ভায়োলেট স্টোনহ্যামের জীবনের পূর্বাপর একটা ভিজ্যুয়াল রেফারেন্স খুঁজে পায় ওই দৃশ্যে। এটা আমাদের তার অতীতে নিয়ে যায় এবং এটাই একমাত্র দৃশ্য যেখান থেকে আমরা বুঝতে পারি, বিয়ের সামান্য কিছুদিন আগে তার সৈনিক হবু-বর যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছে।
সোহিনি ঘোষ: বন্ধুত্ব বা বন্ধন গড়ে ওঠা ঋতুপর্ণর ছবিগুলোর অন্যতম থিম। অসম্ভাব্য ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব হতে পারে, পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে এবং…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: …সামাজিকভাবে অসম বন্ধুত্বও হতে পারে।
সোহিনি ঘোষ: আচ্ছা, তোমার ছবির এই থিমটা গড়ে উঠল কেমন করে?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আমি আমার ছবিতে মূলত বাঙালি মধ্যবিত্ত গৃহস্থালির সব ধরনের আবেগকে ধরার চেষ্টা করি। এ ধরনের কাঠামোতে যেটা হয়, গৃহপরিচারক বা পরিচারিকারা দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে তারাও এক সময় পরিবারের সদস্যে পরিণত হয়। ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’–এ যেমনটা হয়েছে নন্দর মা আর রাধিকার ক্ষেত্রে। আমি নিজেও এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি… এমন হয়েছে যে বাড়িতে তারাই আমার একমাত্র অভিভাবকে পরিণত হয়েছে। আমার বাবা-মা দুজনেই মারা যাওয়ার পর চৌদ্দ রুমের একটা পুরোনো বাড়িতে এখন আমি একা থাকি এবং আমার বাড়ির গৃহকর্মী ও বয়স্ক রাঁধুনীই আমাকে দেখে রাখে। ওদেরকে নিয়েই এখন আমার পরিবার। এজন্য ‘বাড়িওয়ালি’ (১৯৯৯) এবং ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৮) দুটো ছবিতেই গৃহিণীর সঙ্গে তার গৃহকর্মীদের বন্ধন গড়ে ওঠার বিষয়টা আমি দেখাতে চেয়েছি। সিনেমার যে দৃশ্যটুকু একটু আগে দেখানো হলো, সেখানেও এর প্রতিফলন রয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হলো, রাধিকার স্বপ্ন তার বাস্তব জীবনের একটা ভিজ্যুয়াল রেফারেন্স দেয়, যখন সে তার স্বামীর মৃত্যুর পর আবার বাড়িতে ঢোকে। রাধিকা তার সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হয়…
সোহিনি ঘোষ: …যার সঙ্গে তার আবার একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ: এখন আমরা ‘বাড়িওয়ালি’ থেকে একটা স্বপ্নদৃশ্য দেখব, যেখানে কিরণ খের অভিনীত বনলতা চরিত্রের অতীত জীবনের ভিজ্যুয়াল রেফারেন্স রয়েছে। বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার হবু বর সাপের কাপড়ে মারা গেছে। কাজেই কুমারী ও বিবাহিত—দুটোর মাঝখানে একটা জায়গায় অবস্থান করে বনলতা। এই স্বপ্নদৃশ্যটা তার ফেলে আসা অতীতের চিত্রায়ণ।
মশারির ভেতরে নিজের বিছানায় ঘুমোচ্ছে বনলতা। পানিতে ভাসমান মাছের মতন অদ্ভুত ছায়া পড়ে ফ্রেমে। রাতের নিজস্ব শব্দ রূপান্তরিত হয় বিয়ের গানে। চোখে কাজল ও কপালে উজ্জ্বল লালরঙের টিপ দেওয়া বনলতাকে দেখা যায় দরজার আড়ালে। বাড়ির তরুণী গৃহকর্মী মালতীকে সে নিচে গিয়ে বরযাত্রীদের খাবার দিতে আদেশ করে। গাঢ় লালরঙা ফিতায় চুলবাধা ও কপালে সিঁদুর দেওয়া মালতীকে দেখা যায় চা বানাতে। সে গম্ভীরস্বরে উত্তর দেয়: ওরা খাবে না।
—কেন?
—লুচি-রাবড়িতে বেড়ালে মুখ দিয়েছে।
—তা কলাপাতাগুলো কে দেবে?
—প্রসন্নকে বলো।
লালপেড়ে শাড়ি পরা বনলতা লোহার শিক দেওয়া জানালার দিকে এগিয়ে যায়। জানালার ওপরে রঙিন কাচের খিলান। সেখান থেকে তাকালে নিচের উঠোনে রঙিন শাড়ি পরে কয়েকজন মহিলাকে কলাগাছের চারপাশে ঘুরে ঘুরে স্ত্রী-আচার পালন করতে দেখতে যায়। প্রত্যেকের মুখ ঘোমটায় ঢাকা। তাদের দিকে তাকিয়ে বনলতা অনুনয় করে বলে ওঠে, ‘প্রসন্ন! কলাপাতাগুলো তাড়াতাড়ি করে দাও, প্রসন্ন। নিচে ওরা বসে আছে।’ লালশাড়ি পরা প্রসন্ন ঘোমটার আড়াল থেকে মুখ বের করে। প্রসন্ন তাদেরই বাড়ির পরিচারক। সে বলে, ‘এ কলাগাছ তো দেওয়া যাবে না, দিদি।’ ‘কেন?’, জিজ্ঞাসা করে বনলতা। ‘ভেলা তৈরি হবে যে! সাপে কাটা বর তো! কলার ভেলায় ভাসিয়ে দিতে হবে,’ জবাব দেয় সে।
একটা ঘোলাটে পুরোনো আয়নায় বনলতার ছায়া দেখা যায়। চোখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে সে। রাতের শেষে আবার একটা নতুন দিন শুরু হয়েছে।
সোহিনি ঘোষ: তুমি কি এ বাড়ির সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলবে? বনলতা একটা বিশাল পুরনো বাড়িতে একা বাস করে। বাড়ির একটা অংশ সে এক শ্যুটিং ইউনিটের কাছে ভাড়া দিতে রাজি হয়েছে। তার সঙ্গীদের একজন অবাধ্য ও মুখরা তরুণী গৃহকর্মী, আরেকজন হলো বয়স্ক পুরষ…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: …যে আবার প্রচণ্ড রকমের মেয়েলি। কাজেই এমনটা বলা যায় যে ভিন্ন বয়সের তিনজন নারী এখানে একসঙ্গে এক বাড়িতে বাস করছে। বনলতা এজন্য স্বপ্নে পুরুষ গৃহকর্মীকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায়, অর্থাৎ অন্য লিঙ্গে রূপান্তরিত হতে দেখে। এ ছাড়া তরুণী গৃহকর্মীটি যে একসময় বিয়ে করে তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, তা নিয়ে বনলতার মনে যে ঈর্ষাবোধ এবং সার্বক্ষণিক উৎকণ্ঠা কাজ করে তা-ও প্রতিফলিত হয়েছে এই স্বপ্নদৃশ্যে। মালতীকে এজন্য বিবাহিতরূপে দেখে বনলতা। বিয়ে হলে তার যেমন পরিবার হতে পারত, তেমনই এক পরিবার এখানে বনলতা গড়ে তুলেছে তার গৃহকর্মীদের নিয়ে।
সোহিনি ঘোষ: আমাদের আলোচনাটা কেবল দার্শনিক আবিষ্টতায় সীমাবদ্ধ না রেখে এবার অন্য বিষয়ে কথা বলা যাক। বাংলায় ছবি বানানোর ব্যবহারিক বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করি। মাল্টিপ্লেক্স আসার পর ছবির জগতে কেমন বৈচিত্র্য এসেছে, তা নিয়ে আমরা গত কিছুদিন কথা বলেছি। তবে বাংলার অনেক বড় বড় পরিচালককে এখনো ছবির ফান্ড জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। এমনকি এত খ্যাতি ও দুর্দান্ত সব ছবির পরিচালক হয়েও ভয়ানক সময় স্বল্পতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে তোমাকে কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রে বোম্বের তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করলে কি বিশেষ কোন সুবিধা পাওয়া যায়?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: বলিউড তারকাদের বাংলা ছবিতে কাজ করার চর্চা কিন্তু নতুন কিছু নয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’ (১৯৬২) ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ওয়াহিদা রেহমান, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে (১৯৭০) অভিনয় করেছিলেন সিমি গারেওয়াল। তপন সিংহের ছবি ‘হাটে বাজারে’ (১৯৬৭)–এ ছিলেন বৈজয়ন্তীমালা আর ‘সাগিনা মাহাতো’য় (১৯৭০) অভিনয় করেছিলেন সায়রা বানু ও দিলীপ কুমার। তখন ভাবা হতো এসব অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা শুধু বলিউড বা বোম্বের (অধুনা মুম্বাই) না, আমাদের ‘জাতীয় সিনেমা’র একটা অংশ। বাংলা ফিল্মের ইন্ডাস্ট্রিও ছিল সেই জাতীয় সিনেমা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। কিন্তু বর্তমানে বলিউড এবং অন্যান্য ভাষার ছবির মধ্যে এক ধরনের বিভাজন তৈরি হয়েছে।
আমার ছবিগুলোকে আঞ্চলিক সিনেমা বা ‘রিজিওনাল সিনেমা’ বলতে আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি, কারণ অঞ্চলের ভিত্তিতে বলিউডকেও তো তাহলে আমারটার মতো রিজিওনাল বলা যেতে পারে! এক্ষেত্রে ‘ল্যাংগুয়েজ সিনেমা’ কথাটা উল্লেখ করা হলে আমি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি। সেই সঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে যে ‘ল্যাংগুয়েজ সিনেমা’ও কিন্তু বদলে যাচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে তত বেশি বিশ্বজনীন এবং তার বর্তমান রূপের প্রতিফলন হয়ে উঠছে বাংলা ছবি। সচরাচর বাঙালিদের মধ্যে সংস্কৃতি নিয়ে এক ধরনের রক্ষণশীল প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে বর্তমানে তারা অন্য সংস্কৃতি থেকেও গ্রহণ করার চেষ্টা করছে। এসব কারণে সময়ের সঙ্গে বাংলা ছবিতে আরও বেশি সার্বজনীন সংবেদনশীলতার সংযুক্তি লক্ষ করা যাচ্ছে।
সোহিনি ঘোষ: তোমার সিনেমাগুলো অনেকাংশেই নারীকেন্দ্রিক, যারা ট্যাবু ভাঙে, সমাজের বেঁধে দেওয়া বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করে না—এমন। ‘চোখের বালি’তে (২০০৩) যখন তুমি ঐশ্বরিয়া রাইকে নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে, তখন তো কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: কিছু বা সামান্য না…প্রচণ্ড বিতর্ক! কেন একজন বলিউড অভিনেত্রী বাংলা ছবিতে কাজ করবেন, বিশেষ করে ছবিটা যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে তৈরি! পরিহাসের ব্যাপার এই যে, রবীন্দ্রনাথ কখনো জাতিভেদ বা অঞ্চলবিভেদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি এক পৃথিবীতে বিশ্বাস করতেন এবং সেদিক থেকে তাঁকে জাতীয়তাবাদবিরোধী বলা যেতে পারে। নিজের দেশকে তিনি ভালোবাসতেন, কিন্তু মনেপ্রাণে আন্তর্জাতিকতার মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন। তবে বর্তমানে তাঁর ওপর আমরা এতোটাই বাঙালিত্ব আরোপ করে ফেলেছি যে তাঁর গল্পের চরিত্র হিসেবে কোনো অ-বাঙালি অভিনেত্রীকেও মেনে নিতে পারছি না। এটা হাস্যকর বটে! অথচ ওঁর লেখা গান গাওয়ার জন্য পাঞ্জাব থেকে কুন্দনলাল সায়গলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ত্রিপুরার শচীন দেববর্মণকেও বলেছিলেন তাঁর গান গাওয়ার জন্য। তাঁর ত্রিপুরী স্বর নিয়ে কেমন গাবেন, তা নিয়ে বেশ দ্বিধান্বিত ছিলেন শচীন দেববর্মণ। তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, সায়গল যদি গাইতে পারে তবে তিনিও পারবেন।
সোহিনি ঘোষ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তোমার যে গাঢ় ও স্থায়ী সম্পর্ক রয়েছে, তোমার ছবিগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। গল্প বা উপন্যাস অবলম্বনে সরাসরি ছবি বানানোর পাশাপাশি তোমার অন্য অনেক ছবিতেও রবীন্দ্র অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, ‘অসুখ’ (১৯৯৯) ছবিটায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মৃত কবির সঙ্গে ছবির নায়িকার যেন অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব! ছোটবেলায় বাবা-মার মুখে শোনা রবীন্দ্রনাথের কবিতার ওপর ভর করে সে জীবনের সব ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে চলে। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস অবলম্বনে একটা ছবি বানিয়েছ। পাশাপাশি একটা ডকুমেন্টারিও বানাচ্ছ তাঁকে নিয়ে। তোমার আরেক নতুন ছবি ‘চিত্রাঙ্গদা’র উৎসও রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য। আমি জানি, তোমার নিজের জীবনেরও একটা বড় অংশজুড়ে অবস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সঙ্গে তোমার এই সম্পর্কের উৎস কোথায়?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: …মনে হয় সহমর্মিতা… সবার প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে তাঁর যে ভাবনা ছিল, সেটার ওপর আমার প্রচণ্ড সহমর্মিতা কাজ করে। যখন আমরা ব্রিটিশদের অধীনে ছিলাম, তখন ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলা কঠিন কিছু ছিল না। তবে উনিই প্রথম তখনকার জাতীয় নেতাদের সতর্ক করেছিলেন, দেশের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার বীজ বুনে না দেওয়া পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠব না। স্বাধীনতা এলেও আমাদের দাসত্ব কাটবে না। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আবেগপ্রসূত বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার বিপক্ষে মহাত্মা গান্ধীকে সতর্ক করেছিলেন তিনি। কারণ ব্রিটিশরা চলে গেলেও সেই বিদ্বেষ রয়ে যাবে এবং নিজেদের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো পক্ষকে আমরা ব্রিটিশদের জায়গায় দাঁড় করাব। তখন নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই থেকে এ জাতিকে আমরা কীভাবে নিবৃত্ত করব? এবং বাস্তবে কিন্তু ঠিক সেটাই ঘটেছে।
সোহিনি ঘোষ: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানোর সময় নতুন কিছু কি আবিষ্কার করতে পারলে? রবীন্দ্রনাথের জীবনের সঙ্গে কোন জায়গাগুলোতে নিজের জীবনের আলাদা অনুরণন অনুভব করো?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: সম্ভবত তাঁর ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে। সর্বজনীনভাবে তাঁর সময়ের সবচেয়ে নিন্দিত মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমার ব্যক্তিজীবনে যেসব অপমানের মধ্যে দিয়ে আমি যাই, সেগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই… তখন মনে হয় অন্য এক প্রসঙ্গে অরুন্ধতী রায় যেমনটা বলেছিলেন তেমনি, একগালে চুমু আর অন্য গালে থাপ্পড় খেয়ে আমি পথ চলছি।
সত্যজিৎ রায়ের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী হিসেবে আমাকে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু তাঁর পৌরুষ আমি ধারণ করি না। আমার মনে হয়, সত্যজিৎ রায়ের ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর সিনেমা—এ দুটো মিলিয়েই ‘সত্যজিৎ রায়ের ছবি’ হয়ে উঠেছে। তারপর অপর্ণা সেন এলেন, উনি নারীত্বের প্রতিনিধিত্ব করলেন। সেখানেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু লৈঙ্গিক নির্দিষ্টতার বাইরের একজন মানুষ যখন ছবির জগতে পা দিল, মানুষ সেটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া মিথ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ ভাঙতে শিখে যায়… এ প্রসঙ্গে আমার একটা গল্প মনে পড়ে গেল… (সোহিনি ঘোষের দিকে ঘুরে এবং কণ্ঠস্বর কিছুটা নিচু করে) আমি কি ডিভিডি স্টোরের ওই গল্পটা বলব?
অনেক মানুষই আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমার ছবিগুলোকে সোজাসুজি বলে ‘ঋতু-পর্নোগ্রাফি ফিল্মস’।
সোহিনি ঘোষ: কোনটা? (এরপর দর্শকদের দিকে তাকিয়ে) …এমন না যে আমি ওর কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছি… (হাসি)
ঋতুপর্ণ ঘোষ: …এটা একটা মজার গল্প। আপনারা শুনলে বুঝতে পারবেন। সে সময় আমি প্রথমবার মাথা ন্যাড়া করেছি, যার কারণে কলকাতা শহরের অনেক মানুষ আমাকে তখন দেখামাত্র চিনতে পারছিল না। একদিন এক ডিভিডি স্টোরে গিয়েছি। সেখানে দেখি, যে শেলফে আমার সবগুলো ছবির ডিভিডি একসঙ্গে রাখা, তার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায়ের একটা নতুন ছবির ডিভিডিও সাজিয়ে রেখেছে। আমি সেখানকার সেলস পার্সনকে বললাম, ‘এই ডিভিডিটা আমার তাক থেকে সরিয়ে তার অন্য ছবিগুলোর সঙ্গে রাখো।’ এমন সময় এক ভদ্রলোক এসে ‘নিশিযাপন’ (২০০৫) নামে ওই ছবিটার ডিভিডিই খুঁজতে লাগল। দোকানি মেয়েটাকে আমি ইঙ্গিত করলাম, যেন ও ওই লোকটাকে আমার ছবিগুলোর কোন একটা কিনতে প্ররোচিত করে! লোকটার কাছে গিয়ে সে তাই বলল, ‘আপনি কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিগুলোও দেখতে পারেন।’ কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ভদ্রলোক মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি?!’
মেয়েটা বেশ চালিয়ে গেল এবং শেলফে সাজানো আমার ছবিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো। এরপর ভদ্রলোক বেশ রাগতস্বরে বললেন, ‘ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি কি বাড়িতে দেখা যায়? বিশেষ করে পরিবার–বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে?’ মেয়েটা তখন কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না। লজ্জায় পড়ে গেল। কারণ আমিও আবার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমিই তখন এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? ওনার সিনেমাগুলোয় সমস্যাটা কী?’ আমার দিকে ঘুরে উনি তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি দেখেছেন?’ আমতা আমতা করে উত্তর দিলাম, ‘দেখেছি বলেই তো মনে হয়।’ (হাসি)
এরপর উনি আমাকে বিভিন্ন ছবির দৃশ্যের কথা উল্লেখ করে বর্ণনা দিতে শুরু করলেন। আমি বললাম, ‘“তিতলি” (২০০২) দেখতে পারেন… খুব সোজাসাপ্টা একটা গল্প আছে এটায়…’, উনি বললেন, ‘তিতলি?! এর গল্প সোজাসাপ্টা? অপর্ণা সেন যে একটা দৃশ্যে নাইটগাউন খুলে ফেলে আর তখন ওনার পিঠ দেখা যায়। ভুলে গেছেন?’ তারপর বললাম, ‘“শুভ মহরৎ” (২০০৩) তো দেখা যেতে পারে, এটা অগাথা ক্রিস্টির গল্প অবলম্বনে বানানো… কাজেই পরিবার নিয়ে দেখতে তো সমস্যা হওয়ার কথা না…’, ভদ্রলোক তো পুরোপুরি আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। উনি বললেন, ‘ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে হেয়ারড্রেসারের একটা দৃশ্য ছিল, সেটা কি ভুলে গেছেন মশাই?’ (হাসি)
আমার ছবির দৃশ্য তখন আমার কাছেই ফিরে আসতে থাকল। এমন সময় ওই দোকানে আরও কিছু কাস্টমার এসে হাজির হলো এবং তারা আমাকে জিজ্ঞেস করা শুরু করল, ‘ঋতুদা, আপনার নতুন ছবির ডিভিডি কবে রিলিজ পাবে?’ ভদ্রলোককে দেখে তখন মনে হলো, তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। যুক্তি-তর্ক করতে গিয়ে নিজেই ফাঁদে পড়ে গেছেন। এদিকে আমি নিজেও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছি। তাঁকে আমি বললাম, ‘“নিশিযাপন” নিয়ে আপনার এতো আগ্রহ কেন? শুধু নামটা শুনে নিশ্চয়ই… কিন্তু আমিও বলে দিচ্ছি, তেমন রগরগে কিছু ছবিটায় পাবেন বলে আমার মনে হয় না।’ (হাসি)
অনেক মানুষই আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমার ছবিগুলোকে সোজাসুজি বলে ‘ঋতু-পর্নোগ্রাফি ফিল্মস’। (হাসি)
সোহিনি ঘোষ: আচ্ছা, তোমার এই নামটা কীভাবে জুটলো, সে ব্যাপারে মনে হয় আমাদের আরেকটু কথা বলা উচিত। ঋতু ‘অন্তরমহল’ নামে একটা ছবি বানিয়েছিল ২০০৫ সালে। পুরুষতান্ত্রিক শোষণ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ‘অন্তরমহল’ ছিল একটা বড়সড় ধরনের ধাক্কা। এই ছবিটা যখন মুক্তি পায়, ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা তখন ক্ষমতায়…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: …ছবিটা ছিল একজন কুমোরকে নিয়ে। দুর্গামূর্তি গড়ানোর জন্য যাকে আনা হয়েছিল বাংলার বাইরে থেকে। তিলে তিলে নিজের হাতে গড়ে তোলার সময় নগ্ন মূর্তির দেহ নিয়ে তার কল্পনা কাজ করে… আগে তো মূর্তির দেহের আকার দিতে হয়, তারপর আসলে কাপড়ে সেই দেহ আবৃত করা হয়। মূর্তি বানানোর সময় কুমোরের তার প্রতি কামনা কাজ করে…
সোহিনি ঘোষ: …এবং সে একটা স্বপ্নও দেখে…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: দেখে যে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হচ্ছে। দুটোর মধ্যে এই সংযোগটা দর্শকের কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর মনে হয়েছিল…
সোহিনি ঘোষ: …এবং বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণী এই ছবি দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে… ঋতু এরপর তাদের কাছে ‘ভদ্রলোকের ফিল্মমেকারে’র তকমা হারিয়ে ফেলে, যে ফিল্মমেকার তাদের জন্য উপযোগী বাংলা ছবি বানাতো। রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায় এবং ঋতু পায় তাঁর নতুন নাম ‘ঋতু–পর্নো’।
ঋতুপর্ণ ঘোষ: ঋতু–পর্নোগ্রাফি।
সোহিনি ঘোষ: অলংকরণ বা মেয়েদের সাজগোজের ব্যাপারটা তোমার ছবিতে ঘুরেফিরে থিম হয়ে আসে। এ ব্যাপারে কি কিছু বলবে?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: আমার ছোটবেলার একটা মজার গল্প আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি। বাইরে কোথাও যাওয়ার আগে আমার মা যখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজতে বসত , আমি পাশে বসে তার মেকআপ করা দেখতাম। মা প্রথমে চোখে কাজল দিত।
আমি জিজ্ঞেস করতাম: মা, কি করছ?
—চোখে কাজল দিচ্ছি।
—কেন?
—যাতে আমাকে সুন্দর লাগে।
—এখন কি করছ?
—ভ্রু-তে মাসকারা দিচ্ছি।
—কেন?
—যাতে আমায় সুন্দর দেখায়।
—তুমি এখন কি করছ?
—লিপস্টিক দিচ্ছি।
—কেন?
—যাতে আমায় সুন্দর লাগে।
তারপর যতক্ষণ না পর্যন্ত মার মেকআপ করা শেষ হত, আমি পাশে বসে থাকতাম। এরপর জিজ্ঞেস করতাম, ‘শেষ হলো?’
মা বলত, ‘হুম।’
তখন আমি বলে উঠতাম, ‘ও! কিন্তু তোমাকে তো সুন্দর লাগছে না!’ (হাসি)
আসলে মেকআপ করা শেষে আমি মার এমন বড় একটা রূপান্তর আশা করতাম যে ছোট ছোট পরিবর্তনগুলোয় আমার মন ভরতো না। তবে মেকআপ করার সময় মা যেভাবে নিজেকে ছুঁয়ে দিতেন, তা দেখতে আমার ভালো লাগত। এর মধ্যে এক ধরনের আত্মপ্রেম লুকোনো থাকত। মনে হতো বিভিন্ন জিনিস দিয়ে অলংকরণের সময় তাঁর নিজের সঙ্গে নিজের এক রকম কথোপকথন চলছে। মা আমাকে মাঝেমধ্যে তার অন্তর্বাসের ফিতার হুক লাগিয়ে দিতে বলতেন, অথবা পেছনে বোতামওয়ালা ব্লাউজ হলে তার বোতাম লাগিয়ে দিতে বলতেন। কখনো বা শাড়ির কুঁচি ঠিকমতো ভাঁজ করে দিতে বলতেন। কাজেই সাজগোজের সঙ্গে যুক্ত এই অন্তরঙ্গতা এবং নারীদেহের অলংকরণ আমার মধ্যে সবসময় বেশ আগ্রহ জাগাত।
এ মুহূর্তগুলোয় মা আমার কাছে বোনের মতো হয়ে উঠত, আর আমি তার বন্ধুর মতো হয়ে যেতাম। এগুলো নিয়ে উনি কখনো ইতস্ততঃবোধ করতেন না। আর যে কোনো অন্তরঙ্গ প্রয়োজনে মা যে তার ছেলের কাছে সাহায্য চাইবে—এটা আমার কাছেও খুব স্বাভাবিক মনে হতো। আমি বড় হওয়ার পরও এসব কাজে মা আমার কাছে সাহায্য চাইত। সত্যি বলতে, বড় হওয়ার পর আমরা দুজন অনেকটা বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলাম।
গিরিশ কারনাডের ‘উৎসব’ (১৯৮৪) ছবির এক দৃশ্যে রেখা যখন অনুরাধা প্যাটেলকে সাজায়, ওই দৃশ্যটা আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। সামাজিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন নারী একজন অপরজনকে অলংকৃত করছে—এমন দৃশ্যের ভাবনা আমার কাছে চিত্তাকর্ষক লাগত। ‘চোখের বালি’তে একটা দৃশ্য ছিল যেখানে ঐশ্বরিয়া রাইমাকে সাজিয়ে তার স্বামীর কাছে পাঠায়… এই দৃশ্যটাকে উৎসবের প্রতি আমার ট্রিবিউট হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারো।
সোহিনি ঘোষ: ছোট থেকে যখন তুমি বড় হয়ে উঠছিলে, তখন কার নারীত্ব তোমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করত?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: অপর্ণা সেন!
সোহিনি ঘোষ: (দর্শকদের লক্ষ করে) আমার বলতে ভালো লাগে যে অপর্ণা সেনকে কামনা করে বড় হয়েছি আমি। অন্যদিকে তুমি বড় হয়েছে তাঁর মতো হওয়ার বাসনা নিয়ে। এ প্রসঙ্গের সূত্র ধরে এখন আমরা তোমার ছবিতে প্রথাবিরুদ্ধ যৌনতার বিষয়ে কথা বলতে পারি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ (২০১০) এ ধরনের প্রথম ছবি, যেখানে ঋতু অভিনয় করেছে এবং এটার ব্যাপারে আমার পেপারেও আজ আমি আলোচনা করেছি। অন্য একজন ফিল্মমেকার যে তাঁর ছবিতে অভিনয় করতে… বিশেষত এমন একটা রোলে অভিনয়ের জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তার জন্য ঋতু নিজেও খুব খুশি হয়েছিল।
ঋতুপর্ণ ঘোষ: নিজের ছবিতে নিজে অভিনয় করার চেয়ে অন্য কোনো পরিচালকের কাছ থেকে অভিনয়ের প্রস্তাব পাওয়া অবশ্যই সম্মানজনক।
সোহিনি ঘোষ: অফার না আসলেও অভিনয় হয়তো তুমি একসময় করতেই… (হাসি)
ঋতুপর্ণ ঘোষ: হয়তো বা…
সোহিনি ঘোষ: মৃত্যুকে ঘিরে আরেকটি ছবি ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’–এর (২০১১) চিত্রনাট্য লিখেছ এবং সেখানে অভিনয় করেছ ঋতু। এই ছবিটা একজন মাকে ঘিরে, যিনি তার একমাত্র সন্তানের আকস্মিক এবং মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক সামলে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমন সময়ে তিনি আবিষ্কার করলেন যে তার ছেলে ছিল সমকামী। ছেলের প্রেমিকের সঙ্গেও এরপর তার দেখা হয় এবং দীর্ঘক্ষণ অন্তর্দ্বন্দ্বের পর তাদের দুজনের মধ্যে এক রকম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মহিলাটির ছেলের প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করেছে ঋতু। কাজেই এখানের এ গল্পটাও দুজন বিপরীত প্রবণতার মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার গল্প…
‘মেমোরিজ ইন মার্চ’–এর (২০১১) একটি দৃশ্যে দীপ্তি নাভাল এবং ঋতুপর্ণ ঘোষ; ছবিস্বত্ব: শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস
ঋতুপর্ণ ঘোষ: …এবং এ বন্ধুত্ব পুরোপুরি অচেনা দুজন মানুষের মধ্যেও। আক্ষরিক এবং রূপক—দুই অর্থেই তারা একজন আরেকজনের অপরিচিত। মহিলার চিন্তার জগৎ কিংবা ভাবনার জগৎ—দুই ক্ষেত্রেই আমি একজন আগন্তুক…
সোহিনি ঘোষ: এ ছাড়া আমাদের যারা ভালোবাসে এবং চারপাশে ঘিরে থাকে, সমলৈঙ্গিক প্রেম নিয়ে তাদের মধ্যে যে মানসিক প্রস্তুতিহীনতা ও ভীতি লক্ষ করা যায়। এ ছবিটাকে এটার সঙ্গে তাদের এক ধরনের সমঝোতার গল্পও বলা যেতে পারে। প্রথার বাইরে যৌনতার ভিন্ন রূপগুলো নিয়ে ঋতু যে ত্রয়ী চলচ্চিত্রের নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত, তার মধ্যে তৃতীয়টি হলো ‘চিত্রাঙ্গদা’ (২০১২)। ‘মহাভারত’ থেকে অনুপ্রাণিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা অবলম্বনে এই ছবি বানানো হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উদ্যাপনে এটা একটা শ্রদ্ধার্ঘ্য। ঋতু নিজেই এর চিত্রনাট্য লিখেছে এবং পরিচালনা করছে, পাশাপাশি মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ও করছে।
ঋতুপর্ণ ঘোষ: ‘চিত্রাঙ্গদা’র গল্পটাকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেটা নিয়েই আমার ছবিটা। এখানের নামচরিত্র উড়িষ্যার পাশের রাজ্য মণিপুরের রাজকন্যা। মণিপুরের রাজাকে শিব বর দিয়েছিলেন তার বংশে কেবল পুরুষ উত্তরাধিকারী জন্ম নেবে। তা সত্ত্বেও কন্যা চিত্রাঙ্গদার জন্ম হলে রাজা তাকে পুত্রের মতোই বড় করেন। ধনুর্বিদ্যা, যুদ্ধশাস্ত্র, শিকার এবং রাজ্য পরিচালনায় সুদক্ষ হয়ে ওঠে চিত্রাঙ্গদা। একবার শিকারে গিয়ে অর্জুনের সঙ্গে তার দেখা হয়। তার নারীত্ব কিংবা বীরত্ব— কোনটাই আকর্ষণ করে না অর্জুনকে। ভঙ্গহৃদয়ে কামদেবের সাহায্য প্রার্থনা করে চিত্রাঙ্গদা এবং কামদেব তাকে সুন্দরী রমণীতে রূপান্তর করেন। এরপর অর্জুনের কাছে ফিরে যায় সে। কিন্তু আগে বহু সুন্দরী নারী দেখার অভিজ্ঞতা থেকে অর্জুন তার প্রতি আগ্রহ দেখায় না। তবে সে যেহেতু আগে কখনো বলিষ্ঠ ও সুযোদ্ধা রাজকন্যা দেখেনি, চিত্রাঙ্গদাকে তার আগের রূপে দেখতে আকর্ষণ অনুভব করে অর্জুন। চিত্রাঙ্গদা আবারও কামদেবের কাছে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে এবং আগের রূপে ফিরে পেয়ে সে অর্জুনের সমকক্ষ হয়ে ওঠে। লৈঙ্গিক সমতার এই আঙ্গিকটা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি।
আমার ছবিটাকে রবীন্দ্রনাথের নাটকের একটা বিনির্মাণ বলা যেতে পারে। জৈবিক লিঙ্গের ওপর ভিত্তি করে অনেক সময় আমাদের উপর লিঙ্গের প্রথানুগত্য চাপিয়ে দেওয়া হয়। তখন না চাইলেও নির্দিষ্ট কোনো লৈঙ্গিক পরিচয়ের ভার জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়। এই ছবিতে আমি একজন কোরিওগ্রাফারের চরিত্রে অভিনয় করেছি, যে পরিচালক হিসেবে নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’র মঞ্চায়ন করছে। একই সঙ্গে ইচ্ছের বাইরে যে দৈহিক ও লৈঙ্গিকসত্তার ভার তাকে বহন করতে হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করছে…
সোহিনি ঘোষ: ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’–এর মতো এ ছবিটায়ও সিনেমার ভাষায় তুমি এক ধরনের রূপান্তর আনতে চাইছ, তাই না?
ঋতুপর্ণ ঘোষ: একদম।
সোহিনি ঘোষ: সম্প্রতি এক আলাপে তুমি আমাকে বলেছ যে, এখনো এমন সব ছবি বানাতে চায়, যেগুলো শুধু গল্পের ওপর নির্ভর করবে না। ছবিটা দেখে কেউ ফিরে গিয়ে তার আখ্যানের ঠিকমতো বর্ণনা দিতে পারবে না…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: হ্যাঁ, এমনটাই চাই।
সোহিনি ঘোষ: …এসব ছবির আখ্যান লুকিয়ে থাকবে গল্পের বর্ণনভঙ্গির মধ্যে… এবং সেই প্রচেষ্টার একটা সূচনা আমি দেখতে পাচ্ছি ‘চিত্রাঙ্গদা’র ক্ষেত্রে…
ঋতুপর্ণ ঘোষ: কিংবা ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’–এর কথাও বলতে পারো… এর গল্পটা কিন্তু মাথার মধ্যে বহন করে নিয়ে কারও কাছে ঠিকমতো বর্ণনা করা সম্ভব না। ছবিটা দেখাই হবে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা।
সাক্ষাৎকারগ্রহীতার নোট
ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, ওর আর আমার–দুজনেরই বন্ধু নন্দিতা দাশের মাধ্যমে। নন্দিতা ঋতুপর্ণর ছবি ‘শুভ মহরৎ’ (২০০৩)–এ অভিনয় করেছিল। প্রথম দেখাতেই আমাদের মধ্যে ফোন নম্বর বিনিময় হয়। দুজন দুই শহরে বাস করা সত্ত্বেও এরপর আমরা নিয়মিত ফোনে আলাপ করা শুরু করি। দুজনেরই বেশ সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। কাজেই হাতে কতটুকু ফাঁকা সময় আছে তার ওপর ভিত্তি করে ঋতুর সঙ্গে কথা বলেই আমার দিন শুরু হতো। কথা বলতে বলতে কখনো ঘণ্টা পেরিয়ে যেত। আমার বাড়ি আর কর্মক্ষেত্রের সবাই ঋতুর সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক সময় তারাও আমাদের আলাপচারিতায় যোগ দিত।
ঋতুর সঙ্গে আমার প্রথম যখন পরিচয় হয়, ‘অন্তরমহল’ (২০০৫) বানিয়ে ও তখন বেশ বিতর্কের মুখে পড়েছে। আমার কাছে আবার ওই ছবিটা একেবারে অন্যরকম লেগেছিল, অত্যন্ত সাহসী একটা ছবি মনে হয়েছিল। সিনেমা ও যৌনতা নিয়ে আমার কাজগুলো সম্পর্কে ঋতু অনেক বেশি আগ্রহ প্রকাশ করত।
২০১১ সালের জুলাইয়ে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনস্টার তাদের ফিল্ম স্টাডিজের সম্মেলনে আমাকে কি-নোট স্পিচ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। ওই একই সময়ে চলমান লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রণ পেয়েছিল ঋতু। ওয়েস্টমিনস্টারের কনফারেন্সের থিম ছিল ‘হোয়াটস নিউ অ্যাবাউট নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমা?’ আর আমার পেপারটার টাইটেল ছিল ‘অডাশিয়াস বার্ডস অব ডাস্ক: দ্য এমার্জেন্স অব কুয়ার বেঙ্গলি সিনেমা’ টাইটেলের এই ‘অডাশিয়াস বার্ডস’ (উদ্ধত বা দুঃসাহসী পাখি) বলতে আমি মূলত ঋতুকেই বুঝিয়েছিলাম। ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ (২০১০)–এ উদয় (যীশু সেনগুপ্ত) অভিরূপকে (ঋতুপর্ণ ঘোষ) তুলনা করেছিল একটা ‘সুন্দরী সন্ধ্যার পাখি’র সঙ্গে। সেখান থেকেই এই শিরোনামটা নেওয়া। ওই সময়ে ঋতু আমাকে প্রথম কোনো একাডেমিক প্রেজেন্টেশন করতে দেখে। আর ওটাই ছিল শেষবার।
পেপার প্রেজেন্টেশনের পর আমাদের দুজনের মধ্যে একটা কথোপকথন হয়, সেটাই আমি এখানে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছি। ঋতু এমন প্রাণবন্তভঙ্গিতে কথা বলতো যে, অনেক সময় ওর ভঙ্গি, নড়াচড়া বা আকার-ইঙ্গিত কথার জায়গা নিয়ে নিতো। কেউ যদি রেকর্ডেড ভিডিওটা দেখে থাকেন, তার কাছেও এটা স্পষ্ট হবে। এসব কারণে সরাসরি শ্রুতিলিখন করতে গেলে কিছু জায়গা অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজেই স্পষ্টতা ও সহজবোধ্যতার খাতিরে কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিলাম। কিছু বাক্যের গঠনে পরিবর্তন এল, পুনরাবৃত্তি থাকলে মুছে দিলাম এবং কিছু জায়গায় বিস্ময়সূচক বাক্য বা বাক্যাংশ যুক্ত হলো। ঋতু আর আমি—দুজন দুজনের লেখালেখিতে মাঝেমধ্যে সাহায্য করতাম। আলোচনা শেষে যা লেখার কথা থাকত, তার প্রসঙ্গে ও অনেক সময় বলত, ‘তুমি একটু ঠিক করে লিখে দিও।’ এই কথোপকথনটির ক্ষেত্রে আমি ঠিক সেটাই করার চেষ্টা করলাম।